বিলিতি হাওয়ায় শীত ফিরছে ফাল্গুনে
রৎ, হেমন্ত আগেই গিয়েছে। এ বার বুঝি বসন্তের পালা!
আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় বর্ষা গত মরসুমে বাংলাকে তাড়া করে এসেছে ডিসেম্বরের গোড়া পর্যন্ত। ফলে শরৎ আর হেমন্ত দু’টো ঋতুরই অস্তিত্ব কার্যত টের পাওয়া যায়নি। ইউরোপ, আমেরিকা-সহ বিশ্ব জুড়ে বায়ুপ্রবাহের আমূল পরিবর্তনের জেরে বঙ্গে বসন্তের আগমনও সঙ্কটে। কারণ মৌসম ভবনের পূর্বাভাস যদি সত্যি হয়, তা হলে আজ, সোমবার রাজ্যে শীত ফেরার সম্ভাবনা প্রবল।
এবং তার প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে প্রবল ভাবে। বস্তুত ক্যালেন্ডারের পাতায় ফাল্গুন পড়ে গেলেও কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে শৈত্যপ্রবাহের মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে জানিয়ে রেখেছে হাওয়া অফিস! কেন না সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেতে পারে, যেখানে এ সময়টায় কলকাতায় গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকার কথা ১৮ ডিগ্রি।
অর্থাৎ, ফাল্গুন-চৈত্র বসম্তকাল ছোটবেলায় পড়া ঋতু পরিচিতির আপ্তবাক্যটি বেবাক ধরাশায়ী। বস্তুত বসন্তের আগমনী ঘোষণার পরিবর্তে প্রথম ফাগুনে যেন ভরা বর্ষারই ছবি দেখল বাংলা। তবে গুমোট নয়, শীতল বর্ষা। সৌজন্য, বিহার-ঝাড়খণ্ডের উপরে তৈরি ঘূর্ণাবর্ত। উত্তুরে ও পুবালি বাতাসের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যা আকাশ কালো করে একটানা বৃষ্টি নামিয়ে দিল। কখনও মুষলধারে, কখনও ইলশেগুঁড়ি। শনিবার সারা দিন কৃষ্ণনগর-দুর্গাপুর-আসানসোলে বৃষ্টি হয়েছে। রাতে শুরু হয় কলকাতায়। শনিবার রাত থেকে রবিবার বিকেল ইস্তক মহানগরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩৪ মিলিমিটার। রাতভর বর্ষণের দরুণ এ দিন কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দু’টো তাপমাত্রাই নেমেছে। এ দিন সর্বনিম্ন ছিল ১৭ ডিগ্রি, এ সময়ের স্বাভাবিকের চেয়ে ১ ডিগ্রি কম। বাতাসে ফের লেগেছে হিমের ছোঁয়া।
বৃষ্টি মাথায়। রবিবার সন্ধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
সব মিলিয়ে বিদায়োন্মুখ শীত আবার মুখ ঘুরিয়েছে। আগামী ক’দিনে যার জবরদস্ত কামড় মালুম হতে পারে। কিন্তু আবহবিজ্ঞান তো বলে, আকাশ মেঘলা থাকলে বা বৃষ্টি হলে রাতের তাপমাত্রা নামতে পারে না, তাই কনকনে শীতও পড়ে না! তা হলে হাওয়া অফিস দক্ষিণবঙ্গে কড়া শীতের পূর্বাভাস দিচ্ছে কী ভাবে?
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথের ব্যাখ্যা, “সোমবারের মধ্যে ঘূর্ণাবর্তটি দুর্বল হয়ে এখানকার আকাশ পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে। তখন উত্তর ভারত থেকে হিমেল উত্তুরে বাতাস বিনা বাধায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে। তাপমাত্রা নামবে।” গোকুলবাবু জানাচ্ছেন, উত্তর ভারতের বৃষ্টির জেরে দিন দুয়েক আগে মধ্য ও পূর্ব ভারতের একাংশে বৃষ্টি নেমেছে। শেষ দফায় নামল দক্ষিণবঙ্গে। বাতাসে যত জলীয় বাষ্প ছিল, বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগর থেকে নতুন করে জলীয় বাষ্প ঢোকার পরিস্থিতিও আর নেই। “তাই সোমবারই আকাশ ঝকঝকে হয়ে যেতে পারে । দক্ষিণবঙ্গে ঢুকে পড়তে পারে উত্তর ভারতের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া।” বলছেন অধিকর্তা।
তা বলে একেবারে শৈত্যপ্রবাহের পরিস্থিতি?
আবহবিদদের বক্তব্য: সাধারণত শীতকালে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ডিগ্রি নেমে গেলে বলা হয়, শৈত্যপ্রবাহ চলছে। তেমনই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আলিপুরের অনুমান, আজই দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে রাতের তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে। যা নামতে নামতে এ সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার (১৮ ডিগ্রি) চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি নীচেও চলে যেতে পারে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দিনের তাপমাত্রা অবশ্য বাড়ে। কিন্তু আগামী ক’দিন উত্তুরে বাতাসের তীব্রতায় দিনের তাপমাত্রাও খুব একটা চড়তে পারবে না বলে মনে করছে আলিপুর।
তা অসময়ের এই শীতের মেয়াদ কত? বসন্তকে গিলে খাবে নাকি?
সঠিক নির্ঘণ্ট জানাতে না-পারলেও বায়ুপ্রবাহের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে আবহবিদদের মনে হচ্ছে, চলতি সপ্তাহের পুরোটা জুড়ে শীতের আমেজ থাকবে। বাতাসে জলীয় বাষ্প না-থাকায় উত্তুরে হাওয়ার গতিপথে বাধার দেওয়াল তোলার মতো কেউ থাকবে না। পাঁচ-ছ’দিন বাদে আবহাওয়া কতটা পাল্টাবে, তা নির্ভর করছে জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতির উপরে। আবহবিজ্ঞানীদের মতে, যত দিন না কাশ্মীরের বায়ুপ্রবাহ স্থিতিশীল হচ্ছে, তত দিন এ তল্লাটে বসন্তের মুখ দেখানো কঠিন। উত্তুরে হাওয়া বিদায় নিলে তবে ফের দখিনা বাতাসের জন্য বাংলার দরজা খুলবে।
বসন্ত বিলাপ
কেন বৃষ্টি? বিহার ও তার আশপাশে ঘূর্ণাবর্ত। সঙ্গে উত্তুরে আর পুবালি বাতাসের সংঘাত।
কত দিন থাকবে? সোমবার সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা।
তার পরে? উত্তুরে হাওয়া ঢুকবে। তাপমাত্রা নামবে। ফিরবে শীত।
বসন্তের কী হবে? উত্তর ভারতের বায়ুপ্রবাহ স্থিতিশীল হলে তবেই উত্তুরে হাওয়ার দাপট কমবে। ফের বইবে দখিনা বাতাস। তখন আসবে বসন্ত।
উত্তরের বায়ুপ্রবাহে অস্থিরতার কারণ? কাশ্মীরে ঘনঘন পশ্চিমী ঝঞ্ঝা, যা নির্ভর করছে ইউরোপের আবহাওয়ার উপরে।
কিন্তু বসন্তকে ফিরে পেতে বঙ্গবাসীকে কেন জম্মু-কাশ্মীরের মুখ চেয়ে থাকতে হবে?
মৌসম ভবনের ব্যাখ্যা: আবহাওয়ায় বিশ্বজোড়া অস্থিরতারই প্রভাব পড়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। ইউরোপের নানা জায়গায় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি, বন্যায় ভাসছে ব্রিটেন-স্পেন-ইতালির মতো বেশ কিছু দেশ। আবার তুষারপাতে আমেরিকায় বহু অঞ্চলে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। এশিয়ায় ইরান-জাপানেও অকাল তুষারপাত বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অতলান্তিক ও ভূমধ্যসাগরের উপরে জলীয় বাষ্পের সঞ্চার তুঙ্গে পৌঁছেছে। পরিণামে ঘন ঘন তৈরি হচ্ছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা, যা কিনা ইরান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে আছড়ে পড়ছে কাশ্মীরে। বৃষ্টি-বরফে ছেয়ে যাচ্ছে তামাম উপত্যকা। সেই ঝঞ্ঝা নেমে এসে উত্তর ভারতকে বৃষ্টিতে ভাসাচ্ছে। এখন তারই ছোঁয়া লেগে পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টি নেমেছে। মেঘ সব ঝরে গেলে কাশ্মীরি বরফের উপর দিয়ে বয়ে আসা হিমশীতল উত্তুরে বাতাসও ফের মারমার করে ঢুকে পড়বে দক্ষিণবঙ্গে। আবহবিদেরা জানিয়েছেন, ছোটখাটো পশ্চিমী ঝঞ্ঝা তুষারপাত ঘটাতে না-পারলেও উত্তুরে হাওয়ায় নতুন শক্তি জোগাতে সক্ষম।
সে উত্তুরে বায়ু শেষমেশ পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত পৌঁছবে কিনা, তা অবশ্য নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপরে। তবে দুনিয়াজোড়া আবহাওয়ায় বিবিধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জেরে কাশ্মীরে শক্তিশালী পশ্চিমী ঝঞ্ঝার আগ্রাসন যত ক্ষণ জারি থাকবে, তত ক্ষণ এ তল্লাটে উত্তুরে হাওয়া ঠেলে দখিনা হাওয়া ঢোকার সম্ভাবনা কম বলেই আবহবিদদের অভিমত। আপাতত কাশ্মীরের ঝঞ্ঝামুক্তির লক্ষণও বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। “অতলান্তিকের দু’দিকে অস্থির বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে। তার জেরে তামাম মার্কিন মুলুক, ইউরোপ ও এশিয়ার একাংশে বায়ুপ্রবাহে প্রতিকূলতা। অতলান্তিকের বায়ুপ্রবাহ স্থিতিশীল না-হলে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ায় স্বাভাবিক আবহাওয়া ফিরবে না। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার আবর্ত থেকে কাশ্মীরও বেরোতে পারবে না।” বলছেন মৌসম ভবনের এক বিজ্ঞানী।
অর্থাৎ, আগামী ক’দিন অন্তত বাংলার বুকে বসন্তের পথে বাধা বহাল থাকার জোর সম্ভাবনা। উপরন্তু যার হাত ধরে দখিনা বাতাস ফিরে আসতে পারত, বঙ্গোপসাগরে তেমন কোনও নিম্নচাপ বা ঘূর্ণাবর্তেরও ইঙ্গিত এ মুহূর্তে নেই।
বসন্ত না হয় খানিক পরেই এল। কিন্তু এই অকালবর্ষণের প্রভাব কতটা পড়বে? খনার বচন তো বলছে: ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।’ মাঘ ফুরিয়ে ফাল্গুন সবে পড়েছে। বলতে গেলে এটা মাঘের শেষই ধরা যায়। তা হলে কি কৃষির ফলনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে শীত শেষের বর্ষণ?
কৃষি-বিজ্ঞানীরা অবশ্য তেমন কিছু এখনও বলছেন না। ওঁদের বক্তব্য, এক দিনের বৃষ্টিতে লাভ-ক্ষতির হিসেব খুব একটা বোঝা যায় না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.