‘বীরাঙ্গনা’ মমতার পা ধুইয়ে বরণ আদিবাসীদের
দিবাসী মেয়েদের জেদের সামনে পিছু হটতে হল মুখ্যমন্ত্রীকে।
মঞ্চে ওঠার আগে তাঁর পা ধুইয়ে দিতে কলসি করে জল নিয়ে হাজির ছ’জন আদিবাসী মহিলা, সঙ্গে জল ধরার গামলা। হাতে সাদা তোয়ালে। আয়োজন দেখে মুখ্যমন্ত্রী বলে উঠেছিলেন, “না না, এ সব কেন?” কিন্তু শেষ অবধি জিত হল আবেগের। প্রথা মেনেই একটি বড় পাত্রে এক এক করে দু’টি পা রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী। তা ধুইয়ে, মুছে, তাঁর কপালে টিপ পরিয়ে, গালে চুমু খেয়ে, সাদরে বরণ করা হল তাঁকে। ঘোষণা হল, এখন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ‘সানগি দাই।’ যার মানে, বীরাঙ্গনা। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ডুয়ার্সের আদিবাসী সমাজ কাউকে এই সম্মান দিল। বুধবার মালবাজার সেনা ময়দানে আদিবাসী বিকাশ পরিষদের অনুষ্ঠানে মমতা পেলেন এই সম্মান।
আবেগের চুম্বন। বুধবার মালবাজারের সেনা ময়দানে সরকারি অনুষ্ঠানে। —নিজস্ব চিত্র।
কে এই সানগি দাই? তিনি প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এক আদিবাসী বীরাঙ্গনা। মগধের রাজা অজাতশত্রুকে বর্তমান বিহারের রোহতাসে রুখে দিয়েছিলেন তিনি। পরপর তিন বার বিম্বিসারপুত্রের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন আদিবাসীদের দুর্গ। মমতাকেও তেমনই রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় দেখতে চায় আদিবাসী সমাজ, তা স্পষ্ট হয়ে গেল বুধবার। আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকে জানান, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর লড়াকু মনোভাব, ও আদিবাসীদের নানা দাবি -দাওয়া পূরণের জন্য আন্তরিকতা দেখেই ওই সম্মান দেওয়ার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত ভাবে নেওয়া হয়। তাই মুখ্যমন্ত্রী আপত্তি করলেও, প্রথা মেনেই তাঁর পা ধোয়ানো হয়।
সেই সঙ্গে আদিবাসী বিকাশ পরিষদের সর্বভারতীয় নেতারা জানিয়ে দিলেন, আগামী দিনে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই থাকতে চান। অভিভূত মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমিও ওঁদের সঙ্গে থাকব। সকলে মিলেমিশে বাংলাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাব।”
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এমন অনুসরণ বর্তমানের প্রত্যাশাকেও স্পষ্ট করল। আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করবেন মমতা, এই প্রত্যাশা। প্রায় দেড়শো বছর আগে উত্তরবঙ্গে চা বাগান রেললাইন পাতার কাজ করাতে ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকা থেকে আনা হয়েছিল ডুয়ার্সের আদিবাসীদের। নথি বলছে, তাঁদের অধিকাংশই দীর্ঘ পথ হেঁটে ডুয়ার্সে উত্তরপূর্ব ভারতে পৌঁছেছিলেন। বংশপরম্পরায় ডুয়ার্সেই চা বাগান তার লাগোয়া এলাকায় রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এখনও তাঁরা যেন উত্তরবঙ্গে ব্রাত্য।
আদিবাসীরা চান ভাষার অধিকার। তাঁদের আদি ভাষা সাদ্রি কুরুক - পড়াশোনার কোনও ব্যবস্থা হয়নি, সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা হয়নি। হিন্দি কিংবা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করতে হয়। দুই, জমির অধিকার। দীর্ঘ দিন এলাকায় বাস করেও জমির পাট্টা হাতে পাননি বহু আদিবাসী। তিন, আদিবাসীদের বিশেষ অধিকার তৈরির প্রত্যাশা। চার, কাজের অধিকার এবং যথাযথ মজুরির অধিকার।
ডুয়ার্সের মূর্তিতে সরকারি পর্যটন কেন্দ্রে হস্তিশাবক বর্ষণকে খাওয়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেড় বছর আগে এক বৃষ্টির দিনে তিনিই শাবকটির নাম দিয়েছিলেন। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই দাবিগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি আদিবাসীদের জমির পাট্টা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতেও উদ্যোগী হয়েছেন। রেশনের বাইরেও পাঁচটি বন্ধ চা বাগানে দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আলাদা আদিবাসী দফতর গড়ে নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন। করম পুজোয় আদিবাসীদের সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করেছেন। বিরসা তিরকে বলেন, “স্বাধীনতার পরে যাবৎ কোনও দল আমাদের সব দাবিকে গুরুত্ব দেয়নি।”
কিছু সংকটের আশঙ্কা অবশ্য রয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের আশা, তরাই -ডুয়ার্সকে পৃথক তফসিলের আওতা ভুক্ত করে মমতা আদিবাসীদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবেন। কিন্তু আগামী দিনে তরাই -ডুয়ার্সকে ষষ্ঠ তফশিলের আওতায় আনার দাবিতে পরিষদ সরব হলে রাজ্য সরকার কী অবস্থান নেবে, তা নিয়ে অবশ্য সব মহলেই নানা আলোচনা চলছে।
তবে সে ভবিষ্যতের কথা। আপাতত লোকসভা ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ডুয়ার্সের আদিবাসী সমাজের হৃদ্যতার ফলে ডুয়ার্সে তৃণমূলের প্রভাব আরও বাড়ল বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। আদিবাসীদের সব থেকে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন বিকাশ পরিষদ দীর্ঘদিন ধরেই নানা দাবি আদায়ে লড়ছে। একটা সময়ে পরিষদকে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। সে সময়ে পরিষদের নেতা জন বার্লা তাঁর অনুগামীরা মোর্চার সঙ্গে হাতও মেলান। কিন্তু পরিষদের বড় অংশ জিটিএ -তে তরাই -ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতায় সরব হন। তখনই রাজ্যের শাসক দলের নেতা তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের সঙ্গে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে পরিষদের। এখন তা আরও জোরদার হল, মনে করছেন উত্তরের নেতাদের অনেকেই।
বিরোধী দল কংগ্রেস সিপিএম অবশ্য অভিযোগ করছে, ভোটের কথা মাথায় রেখে সরকারি মঞ্চ থেকে আদিবাসীদের জন্য নানা প্রকল্পের কথা ঘোষণা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। দিন মালবাজারের সভা মঞ্চ থেকে ১৮টি প্রকল্পের উদ্বোধন ৩৮টি প্রকল্পের শিলান্যাস হয়েছে। কয়েক হাজার সাইকেল বিলি হয়েছে। পাট্টা দেওয়া হয়েছে। নানা প্রকল্পের ভাতা বাবদ চেকও বিলি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর এক ঘণ্টার বক্তব্যে বারেবারেই আদিবাসীদের নানা সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁর সরকার কতটা আন্তরিক, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। সেই সঙ্গে প্রাপ্য টাকা না দেওয়ায় কেন্দ্রকে দুষেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নাম না -করে কংগ্রেসকে হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু, আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে তার মোকাবিলা করব। আমরা ভিক্ষা চাই না। আগামী দিনে অধিকার আদায় করে নেবে বাংলা।”
সিপিএমের দার্জিলিং জেলার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য জলপাইগুড়ি জেলা সিপিএমের সম্পাদক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রীর নানা ঘোষণা নিয়ে এখনই উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ নেই। তাঁদের কথায়, “ডুয়ার্সের বন্ধ বাগানে আদিবাসীদের দুরবস্থা চলছেই। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা কতটা বাস্তবায়িত হবে সেটা আগামী দিনে বোঝা যাবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.