নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের দুর্বলতা এবং দুঃস্থতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার রাস্তা দেখাল আরামবাগের সালেপুর ১ পঞ্চায়েত।
আরামবাগ মহকুমার পঞ্চায়েতগুলি যখন বছরে সাকুল্যে ৪-৫ লক্ষ টাকার বেশি নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ হয় না। সালেপুর-১ পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের গুণধর খাঁড়া অবশ্য পরিচিত ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে সেই কাজে বিশেষ সাফল্য পেয়েছেন। পঞ্চায়েত এলাকার মাটির তলা দিয়ে ৫ হাজার মিটার কেব্ল লাইন নিয়ে যাওয়ার দরুণ একটি নেটওয়ার্ক সংস্থার কাছ থেকে পঞ্চায়েতটি এক ঝটকায় সাড়ে ১২ লক্ষ টাকা আদায় করতে পেরেছে। নিজস্ব তহবিল পুষ্ট হওয়ার পরে সরকারি তহবিলের মুখাপেক্ষী না হয়ে সেই টাকায় গ্রামোন্নয়নেরও কাজ শুরু করে দিয়েছে।
গুণধরবাবু বলেন, “ওই টাকায় এলাকার সব নলকূপের চাতাল বাঁধিয়ে দিয়েছি। বিভিন্ন গ্রামীণ রাস্তার কালভার্ট করা হয়েছে। কৃষিমেলা এবং আদিবাসী ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি। পরিকল্পনা আছে এলাকার বিভিন্ন স্কুলের পরিকাঠামো খতিয়ে দেখে তা সংস্কার করার।”
সালেপুর-১ পঞ্চায়েত প্রধানের এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে আরামবাগ বিডিও প্রণব সাঙ্গুই বলেন, “পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল মজবুত করতে যত উৎস আছে সেগুলি খুঁজে যিনি যত অভিযান চালাতে পারবেন ততই সেই পঞ্চায়েতের সশক্তিকরণ বাড়বে।”
জেলাতেও প্রশংসা পাওয়া সালেপুর-১ পঞ্চায়েতের এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে জেলার অন্য পঞ্চায়েতগুলি নিজস্ব তহবিল পুষ্ট করতে উদ্যোগী হবে বলে আশা। হুগলির অতিরিক্ত জেলাশাসক (পঞ্চায়েত) সুমন ঘোষ বলেন, “পঞ্চায়েতের আয় বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত অন্য পঞ্চায়েতগুলিকেও উদ্যোগী করবে।”
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি পঞ্চায়েত দফতর থেকে নির্দেশিকাও এসেছে পঞ্চায়েত এলাকার মাটির তলা দিয়ে যে কোনও সংস্থার মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট সংযোগের কেব্ল নিয়ে গেলে সেই লাইন তদ্বিরের জন্য পঞ্চায়েত ফি আদায় করতে পারবে এবং পঞ্চায়েতগুলিকে তা জানিয়েও দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে সালেপুর-১ পঞ্চায়েতের ওই সাফল্যের পরে আরামবাগ ব্লকেরই সালেপুর-২ পঞ্চায়েত, গৌরহাটি-১ ও ২ পঞ্চায়েত, আরান্ডি-১ ও ২ পঞ্চায়েত এবং খানাকুল-১ ব্লকের ঘোষপুর পঞ্চায়েত একই ভাবে নিজস্ব তহবিল বাড়িয়ে নিয়েছে। সালেপুর-২ পেয়েছে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার, গৌরহাটি-১ ও ২ সহ বাকি পঞ্চায়েতগুলি প্রায় ৩ লক্ষ টাকা থেকে ৪ লক্ষ টাকা করে।
আরান্ডি-২ পঞ্চায়েতের প্রধান বাসুদেব মালিক বলেন, “পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিলের অভাবে বেশ কিছু দায়দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে উঠছিল। এ বার সেগুলি স্বচ্ছন্দে করা যাবে।”
ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকার মুখাপেক্ষী না হয়ে পঞ্চায়েতগুলিকে আর্থিক সাবলম্বী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বহু দিন ধরে চেষ্টা চলছে। কিন্তু পঞ্চায়েতগুলির কাছে নিজস্ব তহবিল সৃষ্টির মূল ক্ষেত্র বলতে রয়েছে ভূমি ও গৃহকর আদায়। এ ছাড়া, কিছু কর বহির্ভূত আয়। যেমন, পুকুর লিজ বা ইজারা দিয়ে টোল ও লেভি আদায়। কর বহির্ভূত আয় কোন কোন ক্ষেত্রে আদায় করা যায়, সরকারি নির্দেশিকায় বিস্তর তালিকা থাকলেও স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেই ঝুঁকি নেননি প্রধানেরা। যেমন, খুচরো ও পাইকারি ব্যবসার নিবন্ধীকরণ ফি, যানবাহন নিবন্ধীকরণ ফি, মোটরচালিত গভীর-অগভীর ও ছোট নলকূপের ব্যক্তিগত উদ্যোগের নিবন্ধীকরণ ফি, পঞ্চায়েত এলাকার সমস্ত রাস্তা-ফেরি-সেতুর টোল আদায় ইত্যাদি। এমনকী, কেউ যদি কর না দেন, তার বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত ‘বেঙ্গল পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি’ আইন অনুযায়ী মামলাও করতে পারে। সরকারি নিয়ম, পঞ্চায়েতের সংগৃহীত নিজস্ব তহবিলের অর্থ কমপক্ষে ৫০ শতাংশ এলাকার আর্থ ও সামাজিক উন্নয়নে খরচ করতে হবে। কিন্তু পঞ্চায়েতগুলি নিজেদের অফিস পরিচালনা খাতে ব্যয় করার পর উন্নয়ন খাতে ব্যয় করার টাকা থাকে না বললেই চলে। বিভিন্ন প্রধানদের বক্তব্য, অফিস পরিচালনার খরচ দিন দিন বাড়ছে। উন্নয়ন খাতে খরচ করার সামর্থ্য থাকে না। কেবল কিছু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ে মিটিং করা হয়। নলকূপ মেরামত, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভগ্ন পরিকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও সরকারি তহবিলের অপেক্ষায় থাকতে হয়।
সালেপুর ১-এর দৃষ্টান্তের পর পঞ্চায়েত তার নিজের আয়ের উৎসগুলি খুঁজে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহার করার উদ্যম পাবে বলে প্রশাসনের কর্তাদের আশা। |