প্রবন্ধ ১...
পশ্চিমবঙ্গের দুটি গ্রাম ঘুরে যা দেখলাম
ত ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ প্রতীচী ট্রাস্ট-এর স্বাগত নন্দীর সঙ্গে কুচলিতে গিয়েছিলাম। এই এলাকায় অঙ্গনওয়াড়ি (আই সি ডি এস), মিড ডে মিল, একশো দিনের কাজ (এন আর ই জি এ), রেশন (পি ডি এস) এবং পেনশন প্রকল্পগুলি কেমন চলছে, সেটা দ্রুত এক নজর দেখে নেওয়ার জন্যই এই সফর। কুচলি হল বীরভূম জেলার বোলপুর-শান্তিনিকেতন ব্লকের কঙ্কালীতলা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। বোলপুর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৯ কিলোমিটার। ১৯৮৩ সালে অমর্ত্য সেন ও সুনীল সেনগুপ্ত ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে পুষ্টির পার্থক্য নিয়ে যে দুটি গ্রামে সমীক্ষা করেছিলেন, এটি তাদের অন্যতম।

শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলার জন্য আজ এবং আগামী কাল স্কুল ছুটি। স্কুলবাড়ি বাইরে থেকে দেখলাম, বেশ পাকাপোক্তই মনে হল, সাফসুতরোও।

কুচলিতে দুটি অঙ্গনওয়াড়ি আছে: কুচলি ১ এবং কুচলি ২। প্রথমটার হাল মন্দ নয়, দ্বিতীয়টার অবস্থা ভাল নয়।

কুচলি ১
এই অঙ্গনওয়াড়িটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে একটা চালাঘরে। আমরা ন’টা নাগাদ পৌঁছলাম। দু’জন ছিলেন সেখানে: অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা। জনা পনেরো শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মেয়েটি ২০১২ থেকে আছেন। বেশ মিশুক, চটপটে এবং দক্ষ। তাঁর কী কাজ, সেটা তিনি ভাল জানেন। যে কোনও প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দিলেন। খাতাপত্র সব ঠিকঠাক রাখেন। থাকেন কাছাকাছি গ্রামে, সেখান থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ সাইকেলে যাতায়াত করেন। তিনি গ্র্যাজুয়েট, এক মাস অঙ্গনওয়াড়ি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সহায়িকার বয়স কর্মী মেয়েটির চেয়ে বেশি, এই গ্রামেই থাকেন তিনি।
কর্মী মেয়েটি বললেন, কুচলি ১ কেন্দ্রটির আওতাভুক্ত গ্রামের জনসংখ্যা ৫১৯। অঙ্গনওয়াড়িতে ৪০টি শিশু এবং ৮ জন অন্তঃসত্ত্বা বা স্তনদায়িনী মায়ের নাম নথিভুক্ত আছে। শিশুগুলির মধ্যে ২৫টি ছেলে, ১৫টি মেয়ে। ১৯ জনের বয়স তিন থেকে ছয়। দেখলাম, রান্না চলছে। খাবার: সপ্তাহে তিন দিন ভাত আর ডিম; তিন দিন খিচুড়ি আর আধখানা ডিম। সকলের জন্যই এক খাবার। তিন থেকে ছয় বছরের শিশুরা ওখানেই খেয়ে নেয়, বাকিরা বাড়িতে নিয়ে যায়।
আমরা পরে, বেলার দিকে, অঙ্গনওয়াড়ির ঘরটির পাশ দিয়ে আর এক বার গেলাম। তখন শিশুরা চলে গেছে। কর্মী মেয়েটি বসে বসে রেজিস্টারে লিখছেন।
খাবারের জন্য বরাদ্দ টাকা মনে হল খুবই সীমিত। কত? মেয়েটি বললেন, রোজ মাথাপিছু সাড়ে ছ’টাকা আসে। (সম্ভবত, এটা চাল, তেল এবং নুন বাদ দিয়ে, ওগুলো সরাসরি দেওয়া হয়।) তরকারি বলতে আলু, তা-ও বড় টুকরো দেওয়া যায় না, আলুসেদ্ধ একটু একটু পায় শিশুরা। তবে ডিমটা বাজেটের মধ্যে হয়ে যায়। অনেক বলার পরে গত মাসে ডিমের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়েছে। মেয়েটি তাঁর গ্রাম থেকে ডিম নিয়ে আসেন, তাঁর স্বামী ডিমের জোগান দেন। গ্রামের বাজারে খুচরো কিনলে ডিমের দাম পাঁচ টাকা পড়ে, তবে একসঙ্গে অনেক নিলে সস্তা হয়।

অঙ্গনওয়াড়ি। মন্তেশ্বর, বর্ধমান। জানুয়ারি ২০১৩। ছবি: কেদারনাথ ভট্টাচার্য
পাঁচ বছর বয়েস অবধি শিশুদের ওজন নেওয়া হয় প্রতি মাসে, সেই হিসেব বেশ যত্ন করে বাঁধিয়ে রাখা হয়। মেয়েটি তালিকা না দেখেই বললেন, একটিমাত্র শিশুর ওজন ‘লাল’ মার্কায় আছে, অর্থাৎ অত্যন্ত কম, বাকিরা সবুজ বা হলুদ। সেই শিশুটি কে, মেয়েটি জানেন। তাকে দেখেই এত শীর্ণ মনে হল যে, তালিকাটি আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য। প্রতি মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার কাছেই একটি স্কুলে ‘ক্যাম্প’ করে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। কর্মী মেয়েটির কাছে ভ্যাকসিন দেওয়ার রেজিস্টার আছে। দেখলাম সেটি বেশ ভাল করে রাখা হয়। মেয়েটিকে সব মিলিয়ে মোট এগারোটি রেজিস্টার রাখতে হয়। তার মধ্যে আছে উপস্থিতির হিসেব, গ্রোথ চার্ট, শিশু এবং প্রসূতিদের জন্য দুটি আলাদা ভ্যাকসিনের নথি, জিনিসপত্র কতটা মজুত আছে তার হিসেব, তেল, নুন ইত্যাদির জন্য ‘ফর্ম ৪’, মায়েদের মিটিংয়ের রেজিস্টার ইত্যাদি। মেয়েটি আমাকে তাঁর ‘ভিজিটর্স বুক’-এ মন্তব্য লিখতে বললেন। দেখলাম, সেখানে প্রত্যেক মাসে সুপারভাইজর তাঁর মতামত লিখেছেন।
মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোনও সমস্যা আছে কি না। প্রথমে তিনি বললেন, গ্রামের মানুষ খুব সহযোগিতা করেন। তার পর জানালেন, ঘরটা বড় ছোট, সেটা এক সমস্যা। বিশেষ করে বর্ষার সময় সব শিশু ভিতরে থাকে, তখন কষ্ট হয়। একটা টয়লেট আছে, কিন্তু চালু অবস্থায় নেই। পাশের স্কুলে টয়লেটটা কিন্তু ঠিকঠাক।
প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে কী কী করানো হয়? জানা গেল, রং চেনা, গান, কবিতা, খেলাধুলো, গল্প বলা ইত্যাদি। ঘরটিতে কিছু খেলনা, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার নানা সরঞ্জাম দেখলাম, তবে কতটা সত্যি সত্যি হয়, সেটা পরিষ্কার নয়। আমরা যখন উঠছি, মেয়েটি শিশুদের গান গাইতে বললেন। ওরা খুব খুশি হয়েই একটা গান গাইল।
সব মিলিয়ে, বেশ আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

কুচলি ২ (আসলে, আদিবাসী পাড়া সেন্টার)
এখানে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি পাড়ার মধ্যে একটা ছোট্ট মাটির ঘর। আসলে একটা রান্নাঘর। কর্মী মেয়েটি সেই ঘরের সামনে একটা খাটিয়া পেতে বসে ছিলেন। সহায়িকা রান্না করছিলেন। ডিম ছিল। শিশুদের খেলার জন্য এক চিলতে জায়গা আছে, তবে তাদের খেলানোর কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ল না। পাশে একটা হ্যান্ডপাম্প আছে, কিন্তু অকেজো।
কর্মী মেয়েটি পাশের গ্রাম থেকে সাইকেলে আসেন। নিজে আদিবাসী নন। সহায়িকা গ্রামের আদিবাসী পাড়ার মানুষ। কর্মী মেয়েটি বললেন, তিনি শিশুদের গ্রোথ চার্ট রাখেন, তবে সেটা তাঁর বাড়িতে আছে। অন্য সব খাতাপত্রও বাড়িতেই রাখেন। এখানে কেবল খাওয়ানো হয়। চল্লিশ-বিয়াল্লিশটি শিশু খাবার পায়। রোজকার কাজ, খাবারের বাজেট, এ-সবের যে হিসেব পাওয়া গেল, সেটা কুচলি ১-এরই মতো। মেয়েটির অভিযোগ, বর্ষার সময় খুব সমস্যা হয়, জল জমে যায়, রান্না করাও কঠিন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে কাছের স্কুলটি এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে।
এই পাড়াটির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, গ্রামের জন্য প্রচলিত প্রকল্পগুলি সম্পর্কে তাঁরা প্রায় কিছুই জানেন না, তাঁদের কী প্রাপ্য সে বিষয়েও তাঁদের ধারণা অতি সীমিত। এমনকী রেশন সম্পর্কেও তাঁরা অজ্ঞ।

আদিবাসী পাড়া
কুচলি ২-এর পাড়াটাতে আমরা রেশন নিয়ে খোঁজখবর করলাম। তার পর স্থানীয় রেশন ডিলারের বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। পিডিএস-এর হাল খুব খারাপ। আদিবাসী পাড়ার মানুষ নিজেদের স্বত্বাধিকার কী, সেটা ভাল করে জানেনই না। ওঁদের কাছে দেখলাম সেই পুরনো রেশন কার্ড, পরিবারের নামে নয়, ব্যক্তির নামে, মান্ধাতা আমলের নকশা, ছেঁড়াখোঁড়া, কিছুই লেখা নেই, বস্তুত কিছু লেখার বিশেষ জায়গাই নেই। এপিএল এবং বিপিএল-এর জন্য আলাদা রঙের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু ওঁদের কাছে যে কার্ডগুলো আছে সেগুলো সব এক রঙের। রেশন দোকান থেকে কী পান? কথা বলে বোঝা গেল যখন যা দেওয়া হয় তা-ই নিয়ে আসেন। লোকে এপিএল এবং বিপিএলের তফাতটাই বিশেষ বোঝেন বলে মনে হল না। নানা ভাবে খোঁজখবর করে এইটুকু আন্দাজ পেলাম যে, একটা পরিবারে তিন জন মানুষ থাকলে সপ্তাহে দু’কিলো গম এবং তিন কিলো চাল মেলে। (কুচলি ১ পাড়ায় মানুষের ধারণা অনেক পরিষ্কার।) পনেরো-কুড়ি জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে মাত্র এক জন মহিলার অন্ত্যোদয় কার্ড আছে। তিনি বললেন, সপ্তাহে চার কিলো চাল এবং তিন কিলো গম পান, আর এক লিটার কেরোসিন। এ-সবের জন্য তাঁকে ত্রিশ টাকা খরচ করতে হয়।

ডিলার
এ বার গেলাম স্থানীয় ডিলারের বাড়িতে। বাড়িটা রীতিমত বড়, বোলপুরের কাছে অন্যান্য গ্রামেও যেমনটি দেখেছি। বাড়ির আরও কাজ চলছে দেখলাম। রেশন দোকানটি অন্য পাড়ায়, সেটি দেখার সুযোগ হল না, ডিলারের বাড়িতে বসেই চা খেলাম। তিনি বললেন, ১৯৯৭ সালের বিপিএল তালিকা ধরেই কাজ চলছে। ডিলারের কাছেই জানা গেল, রেশন কার্ড দেখে এপিএল না বিপিএল বোঝা যায় না, তিনিই জানেন কে কী। তাঁর কাছে একটা ছাপানো তালিকা আছে, গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে দিয়েছে, সেই অনুসারে তিনি রেশন দেন। তালিকাটি রেশন দোকানে, তাই আমরা তা দেখতে পাইনি। পরে অবশ্য ডিলার বললেন, কিছু কিছু কার্ডে এপিএল না বিপিএল সেটা লেখা আছে, কিন্তু কার্ডগুলির রং আলাদা নয়।
এই ডিলার চারটি গ্রামে রেশন দেন, সব মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজার কার্ড তাঁর এক্তিয়ারে (তাঁর হিসেবে ৭২৫ বিপিএল, ৩৯৭ অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা, বাকি এপিএল; এই হিসেব ঠিক হলে সত্তর শতাংশই এপিএল)। দু’জনের অন্নপূর্ণা কার্ডও আছে, তবে তাঁদের এক জন মারা গেছেন। ডিলার জানালেন, বিপিএল কার্ড যাঁদের আছে, তাঁরা সপ্তাহে এক কিলো চাল এবং সাড়ে সাতশো গ্রাম আটা পান, তবে বয়েস বারোর নীচে হলে পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যায়, আর কার্ড পুরনো হলে আরও মুশকিল। তিনি আরও বললেন, এপিএল-এর বরাদ্দ এক রকম থাকে না। সপ্তাহে এক কিলো অবধি ‘নিশ্চিত’ পাওয়া যায়, কখনও কখনও আর একটু বেশিও হয়। আটা পাওয়া যায় না। কেন, সেটা ‘অনুমান’ করা যায়।
কেরোসিনের কোটার ব্যাপারটাও বেশ গোলমেলে। ডিলার বললেন, এপিএল এবং বিপিএল, দু’রকম কার্ডেই মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে ২০০ মিলিলিটার কেরোসিন দেওয়া হয়, চতুর্থ সপ্তাহে দেড়শো মিলিলিটার! সব মিলিয়ে একটা বিভ্রান্ত এবং বিভ্রান্তিকর বন্দোবস্ত। বিভ্রান্ত করার জন্যেই কি ব্যবস্থাটা এই ভাবে তৈরি হয়েছে?
ডিলার নিজেই স্থানীয় গুদাম থেকে সব জিনিস নিয়ে আসেন। কমিশনের হার: এক কুইন্টাল চালের জন্য ৩৫ টাকা (এপিএল এবং বিপিএল দুই ক্ষেত্রেই), আটার জন্যও একই। এক লিটার কেরোসিনের জন্য কমিশন ৬৫ পয়সা। ডিলার বললেন, এটা ‘যথেষ্ট’ নয়।
তিনি বারো বছর এখানে ডিলারের কাজ করছেন। দাবি করলেন, তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁর দোকান সপ্তাহে তিন দিন খোলে: বৃহস্পতি, শুক্র, শনি। সকাল আটটা থেকে বারোটা, বিকেল তিনটে থেকে ছ’টা। কঙ্কালীতলার বাইশটি গ্রাম মিলিয়ে ডিলার তথা রেশন দোকানের সংখ্যা পাঁচ। দু’এক মাস অন্তর অন্তর ইনস্পেক্টর আসেন। ডিলার মানলেন যে, গ্রাহকদের রেশন কার্ডে কিছু লেখা হয় না। তবে তাঁর দাবি, নিজের সেলস রেজিস্টার, স্টক রেজিস্টার ইত্যাদি নথিতে সব কিছু লিখে রাখেন।

(চলবে)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.