প্রবন্ধ ২...
শরৎচন্দ্র ব্রহ্মদেশকে চেনেননি, চিনতে চাননি
পনিবেশের ভুল শুধরে এগিয়ে যাওয়ার মোক্ষম সুযোগ এখন কলকাতার সামনে। তার জন্য কেবল রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও সাহিত্যপ্রেম এড়িয়ে অন্য পথে ভাবতে হবে। বাঙালির জাত্যভিমানে মায়ানমারের কিছু আসে যায় না।
কথাটা মনে হল ভারত-মায়ানমার কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কলকাতায় সদ্য ঘটে-যাওয়া আলোচনাচক্রের প্রেক্ষিতে। ‘লুক ইস্ট’ নীতির দৌলতে মায়ানমার এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ইতিমধ্যে দেড়শো কোটি ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে অঙ্কটা তিনশো কোটিতে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে দু’পক্ষ। মায়ানমার থেকে মুখ্যত কৃষিপণ্য আমদানি করে ভারত, সে দেশে রফতানি হয় ইস্পাত এবং ওষুধ। আরাকান অঞ্চলে খনিজ তেল এবং গ্যাসের ব্লকও নিয়েছিল ভারত, কিন্তু উপযুক্ত পাইপলাইনের অভাবে বছর কয়েক আগে তা চিনকে বেচে দিতে হয়েছে। মায়ানমারের খনিজ তেল এবং গ্যাস এখন পাইপলাইন বেয়ে, ভারতে নয়, সটান চিনে চলে যায়।
এই প্রেক্ষিতে দুই দেশই সীমান্ত বাণিজ্য প্রসারের এবং নানা পথে কাছাকাছি আসার চেষ্টায়। এই বছরেই চালু হবে ইম্ফল-ম্যান্ডালে উড়ান। মণিপুরের ইম্ফল থেকে মায়ানমারের ম্যান্ডালে অবধি ৫৭০ কিমি বাসরাস্তাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। কলকাতা হতেই পারে এই ‘পুবে তাকাও’ নীতির সদর দরজা, কিন্তু সে জন্য তাকে অনেক দূর এগোতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের জনসমাজ এবং মিডিয়া যা-ই ভাবুক না কেন, শরৎচন্দ্র আর বাংলা সাহিত্যে মায়ানমারের চিড়ে ভিজবে না।
এই দেশটা উনিশ শতকের বার্মা নয়। তারও আগে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে এক দল দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার অন্যদের হঠিয়ে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ওই ঘোড়সওয়াররা নিজেদের বলত, মায়ানমা। সেই পূর্বসূরিদের নামেই সামরিক শাসকেরা দেশের নাম বদলে রেখেছেন মায়ানমার। রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গনও তার গৌরব হারিয়েছে, আট বছর আগে সেখান থেকে ২৫০ কিমি দূরে নেপিত’ শহরে তৈরি হয়েছে নতুন রাজধানী। জাতীয়তাবাদ স্বাভাবিক ভাবেই মুছে দিচ্ছে উপনিবেশের স্মৃতি। আমরা যেমন ডালহাউসি স্কোয়ারকে বিবাদী বাগ বানিয়েছি, ইয়াঙ্গনেও সে রকম ফ্রেজার স্ট্রিটের নাম এখন আনিয়াথা লেন।
এই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র কোন কাজে আসবেন? রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭ সাল অবধি বার তিনেক ইয়াঙ্গনে গিয়েছেন। কিন্তু সেটি বিদেশ গণ্য করা যাবে না। তখন ইয়াঙ্গন, ম্যান্ডালের কলেজে কলকাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমেই পড়াশোনা হয়। ১৯৩৭ সাল অবধি বার্মা ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত ছিল। শরৎচন্দ্রও কেরানির চাকরি করতে বার্মা পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু এলাকাটি চিনতে চাননি। শ্রীকান্ত জানায়, ‘শহরে যেদিন পদার্পণ করিলাম, ব্রহ্মবাসীদের কি একটা পর্বদিন। দলে দলে ব্রহ্ম নরনারী তাহাদের মন্দিরে চলিয়াছে।’ মনোভাব স্পষ্ট। ব্রহ্মবাসীরা বৌদ্ধ, তাদের মন্দিরকে প্যাগোডা বলে এমনকী নদীর নামও রেঙ্গুন, এ সবের কিছুই পাঠককে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি শরৎচন্দ্র। উপনিবেশের সদর দরজা খিড়কির বাসিন্দাদের প্রতি এই রকমই তাচ্ছিল্য দেখিয়ে থাকে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কলকাতার সঙ্গে ইয়াঙ্গনের সম্পর্ক ছিল সেটিই। সদর বনাম খিড়কি। আজও রেঙ্গুন নদীর সামনে ভিড়াক্রান্ত স্ট্র্যান্ড রোড অবিকল কলকাতার সমনামা পথটির মতো। ৩৭ নম্বর স্ট্রিটে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মতো ফুটপাথ জুড়ে বইয়ের পসরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেও কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংস সংরক্ষণ করতে ইয়াঙ্গনের ঔপনিবেশিক আমলের বাড়ি ভরসা। দুটি শহর আদলে প্রায় যমজ। কিন্তু এতে বাঙালির কৃতিত্ব নেই। ব্রিটিশরা নদীর ধারে দুটি রাজধানী একই ছাঁচে গড়ে তুলেছিল।
সদর আর খিড়কির সম্পর্ক পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল ১৯১৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের সময়। ভারতীয় নেতাদের হাতে প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতা দিয়েও রিপোর্টে লেখা হল, ‘বার্মা ভারত নয়। ওখানকার অধিবাসীরা রাজনৈতিক চেতনায় অত উন্নত নয়, তাদের স্বায়ত্তশাসন দিয়ে আপাতত লাভ নেই।’ তখন বার্মাপ্রেমিক বাঙালির কণ্ঠে কোনও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি। জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলি চলার পর গাঁধীর নেতৃত্বে যে আন্দোলন, সেখানে কিন্তু ছবিটা অন্য। ইয়াঙ্গনের ছাত্ররাও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে।
কিন্তু আজকের মায়ানমারকে বুঝতে হবে তার নতুন সামরিক জাতীয়তাবাদের নিরিখে। প্রায় সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে দুনিয়ার দীর্ঘকালীন সামরিক শাসন। এত দিন বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, এখন আস্তে আস্তে দরজা খুলছে। গত ডিসেম্বরে ইয়াঙ্গন থেকে ম্যান্ডালে থেকে মউলামিন— প্রায় বারো দিন চরকি পাক খেয়ে টের পেয়েছি, সময় বদলাচ্ছে। এখন ফুটপাথে আং সান সু চি-র মুখ আঁকা টি শার্টও প্রকাশ্যে বিক্রি হয়। অর্থনীতির খাতিরেই সামরিক শাসন এখন দরজা খুলতে বাধ্য হচ্ছে। গত সাড়ে চার দশকে সে দেশে শুধু কৃষি এবং কুটিরশিল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের কাছে তারই বিপণন। কোথাও গ্রামে গাড়ি থামিয়ে দেখানো হল, তালের রস জ্বাল দিয়ে কী ভাবে গুড় তৈরি হয়। পাশেই সেই গুড়ের প্যাকেট। একটি ছেলে দেখাল, কোন গাছের নরম গুঁড়ি থেকে সে কী ভাবে বার্মিজ ছাতা তৈরি করে। দেখতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু ক্ষুদ্র শিল্পের চুষিকাঠিতে উন্নয়নের ভবী ভোলে না। পশ্চিমবঙ্গ সেটা কবে বুঝবে, কে জানে, মায়ানমার কিন্তু এখন নির্মাণ ও ভারী শিল্পে লগ্নি খুঁজছে। চিন, জাপান, কোরিয়া সকলে সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ইয়াঙ্গন বা ম্যান্ডালেতে নতুন বাড়ি মানেই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চিনা ছাঁদের বহুতল সাদা বাড়ি। রাস্তায় বেশির ভাগ গাড়িই মেড ইন কোরিয়া বা জাপান। তার মধ্যেই এক দিন ইয়াঙ্গন থেকে ম্যান্ডালে আসার রাস্তায় চোখে পড়ল ‘টাটা মোটরস’-এর অফিস। সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ি তৈরি হলে কলকাতা-ইয়াঙ্গন সম্পর্ক কি এই দুনিয়ায় নতুন মাত্রা পেত?
কলকাতা যদি ‘পুবে তাকাও’-এর সদর হতে চায়, নতুন এই শিল্প-সম্ভাবনার সুযোগ নিতে হবে। মায়ানমারে এখনও এটিএম মেশিন নেই, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড চলে না। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সামরিক শাসকদের সেই ব্যাঙ্কিং সেক্টর উন্মুক্ত করতে হবে। কলকাতার তথ্যপ্রযুক্তি বা ব্যাঙ্কিং সেক্টর সেই উন্মোচনের তক্কে তক্কে থাকতে পারবে?
কলকাতা সুযোগ নিতে পারে রত্ন ও অলঙ্কার ব্যবসার। বাঙালি কারিগরেরাই তো মুম্বইয়ের জাভেরিবাজার বা সুরাতে হিরে কাটার কাজ করেন। মায়ানমার চুনি, পান্না, পোখরাজের খনি বা ২২ ক্যারাটের পাতলা সোনার পাতের জন্য বিখ্যাত। সংস্কৃতে দেশটির নামই ছিল সুবর্ণভূমি।
ইতিহাসের যোগাযোগটাও নিশ্চয়ই তুচ্ছ করার নয়। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, দীর্ঘতম সামরিক শাসনের এই দেশটিকে চিনতে হবে তার ছকে। মায়ানমারের রাখিন রাজ্য প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ। সাবেক আরাকানেরই নাম আজ রাখিন। সেখানকার এক রাজা পালিয়ে গৌড়ে এসেছিলেন, পরে দেশে ফিরে সিংহাসন পুনর্দখল করেন। তাঁর রাজত্বেই বাংলা ভাষায় আলাওল লেখেন তাঁর পদ্মাবতী কাব্য, দৌলত কাজী লেখেন লোর চন্দ্রাণী। মায়ানমারে বাঙালির ‘নম্র শক্তি’ চেনাতে গেলে তাই উনিশ শতকের গণ্ডিতে আটকে থাকলে চলবে না। কখনও পিছিয়ে যেতে হবে, কখনও এগিয়ে আসতে হবে। মায়ানমারকে তার সভ্যতা, সংস্কৃতি নিয়ে যদি হাল আমলে কোনও বাঙালি তাঁর উপন্যাসে যথার্থ ভাবে তুলে থাকেন, তিনি অমিতাভ ঘোষ। ‘শ্রীকান্ত’ বা ‘পথের দাবী’র ব্রহ্ম-বর্ণনা তাঁর ‘গ্লাস প্যালেস’-এর ধারে-কাছে পৌঁছয় না। ব্রিটিশদের হাতে বর্মার শেষ রাজা থিবা-র নির্বাসন থেকে বার্মা টিকের জঙ্গল, মালয়ে রাবার চাষ, আজাদ হিন্দ ফৌজ থেকে সু চি— সব কিছু সেই উপন্যাসে গেঁথে দিয়েছিলেন লেখক। হাল আমলে সেই বই পড়েই মুম্বইয়ের সুধা শাহ থিবা ও তাঁর পরিবারের তথ্যকুলজি বের করে লিখেছেন বৃহদায়তন ইতিহাস: দ্য কিং ইন এগজাইল। সেই বই প্রথম জানাল, থিবার মেজ মেয়ে সাধারণ এক বর্মী পুরুষকে বিয়ে করে কালিম্পং-এ থাকতেন। ১৯৫৬ সালে এসএসকেএম হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।
মায়ানমারকে তাই দেখতে হবে নতুন চোখে। আমরা সদর, ওরা খিড়কি, আমাদের বাংলা সাহিত্য পড়ে ওরা গদগদ হবে— এই সব বস্তাপচা ঔপনিবেশিক ভাবনার অভ্যেস ঝেড়ে ফেলার সময় এসেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.