লেভি দেওয়ার হাত থেকে রেহাই চাইছেন বর্ধমানের গোবিন্দভোগ চাল উৎপাদকেরা। তাঁদের দাবি, হয় ধার্য্য লেভির সরকারি মূল্য বাড়ানো হোক, নাহলে লেভি থেকে সুগন্ধী বাসমতী উৎপাদকদের রেহাই দেওয়া হোক।
বাসমতী উৎপাদকেরাই জানান, কয়েকবছর আগে বাজার থেকে ধান কিনে অন্য মিলে সেদ্ধ চাল তৈরি করে তাঁরা লেভি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে গোলমালও হয়। আরেকবার জেলা খাদ্য দফতরের নির্দেশে স্বর্ণ আতপ ধান থেকে ৩১৬০ টন চাল তৈরি করার পরেও খাদ্য দফতর সে লেভি নিতে চায়নি বলে তাঁদের অভিযোগ। ফলে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে গোবিন্দভোগ উৎপাদক চালকলগুলি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে হরিয়ানা, পঞ্জাবের বাসমতী উৎপাদকদের মতো লেভির আওতা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়ার আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বর্ধমানের দক্ষিণ দামোদর-সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অন্তত ২০টি চালকল রয়েছে, যারা সারা বছর শুধু গোবিন্দভোগ চালই উৎপন্ন করে। বর্তমানে শুধু বর্ধমানেই ওই সুগন্ধী চাল উৎপন্ন হয় ৫০,০০০ টন। উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গোবিন্দভোগ চাল চাষের পরিমাণও। একসময়ে বর্ধমানের রায়নায় শুধু ওই ধানের চাষ হতো। কিন্তু এখন খণ্ডঘোষ, ভাতার, হাটগোবিন্দপুর, মালম্বা, বনপাশ, গলসি, বলগনা ইত্যাদি জায়গাতেও ওই চাষ হয়। সুগন্ধী চালের চাষ বাড়ছে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দুই মেদিনীপুর, মালদা ও বীরভূমেও। বর্তমানে ওই ধানের দাম কুইন্ট্যাল প্রতি ৩২০০ থেকে ৩৬০০ টাকা। আর উৎপাদিত গোবিন্দভোগ চালের দাম ৬-৭ হাজার টাকা প্রতি কুইন্ট্যাল। চাষিদের দাবি, ভাল দাম পেয়েই ওই ধান চাষে ঝুঁকছেন তাঁরা।
বর্ধমান গোবিন্দভোগ মিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দশরথপ্রসাদ অগ্রবাল বলেন, “আমাদের উৎপন্ন করা গোবিন্দভোগ দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে সরাসরি চলে যাচ্ছে। আগে যেখানে অন্ধ্রের গোবিন্দভোগ একচেটিয়া বাজার ধরতো, সেখানে কেরল, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, পুদুচেরির বাজার সিংহভাগ দখল করে ফেলেছে বর্ধমানের গোবিন্দভোগ। কিন্তু লেভি সমস্যা রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “লেভি হিসেবে গোবিন্দভোগ চাল নিতে চায়না রাজ্য সরকার। তা ছাড়া যেহেতু ওই চালের দাম সেদ্ধ চালের চেয়ে অনেক বেশি, তাই উৎপাদনের শতকরা ৫০ ভাগ গোবিন্দভোগ লেভি দিয়ে দিতে হলে আমাদেরও প্রচুর লোকসানের আশঙ্কা। তাই আমাদের দাবি সরকার এই চালের সংগ্রহমূল্য বাড়াক।”
ওই সংগঠনের দুই সদস্য আহ্লাদিপুর ও শ্যামসুন্দরের দুই গোবিন্দভোগ উৎপাদক শেখ রবিউল হক ও উৎপল রায় বলেন, “২০০৮ সালে সেদ্ধ চালের মাধ্যমে লেভি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। জেলাপরিষদ থেকে বলা হয়েছিল প্রতিটি গোবিন্দভোগ উৎপাদককে চালকল পিছু ২০০-৪০০ টন সেদ্ধ চাল লেভি দিতে হবে। ফলে আমরা বাজারে ধান কিনে অন্য চালকলে সে ধান থেকে চাল তৈরি করে লেভি দিতে বাধ্য হই। কারণ আমাদের চালকলের যে পরিকাঠামো তাতে সেদ্ধ চাল তৈরি করা সম্ভব নয়।” বহু টালবাহানার পরে খাদ্য দফতর সে লেভি নিয়েছিল। ২০১১ সালেও খাদ্য দফতর গোবিন্দভোগ উৎপাদকদের স্বর্ণ আতপ দিয়ে লেভি দিতে বলায় তাঁরা বাজার থেকে ধান সংগ্রহ করে ফের ভিন চালকলে পাঠিয়ে চাল বানান। উৎপাদকদের দাবি, ৩১৬০ মেট্রিক টন আতপ চাল টানা ছ’মাস ধরে গুদামে পড়ে ছিল। খাদ্য দফতরে বারবার চিঠি লিখেও লেভি নেওয়ানো সম্ভব হয়নি। তাই ছ’মাস পরে গুদামে থেকে নিম্নমানে পরিণত হওয়া চাল ক্ষতি স্বীকার করে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতে হয়েছিলেন চালকলের মালিকেরা বলে উৎপলবাবুদের দাবি।
গোবিন্দভোগ মিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, গতবারও খাদ্য দফতর লেভি দিতে বলে তাগাদা শুরু করায় তাঁরা সমিতির তরফে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে যদি তাঁরা লেভির প্রয়োজনে সেদ্ধ চাল উৎপন্ন করেন তাহলে গোবিন্দভোগের মানের অবনতি হবে। আর চালের মান কমলে দক্ষিণ ভারতের বাজার হারাবেন তাঁরা। ফলে একদিকে যেমন চাষিরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন, তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন মিলের মালিক ও কর্মীরা। এই চিঠি পাঠানোর পরে অবশ্য তাঁদের আর লেভির জন্য তাগাদা করা হয়নি। তবে এ বার মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে তাঁরা আবেদন জানাতে চান, হয় তাদের পঞ্জাব, হরিয়ানার বাসমতী উৎপাদকদের মতো লেভির আওতার বাইরে পাকাপাকি ভাবে রাখা হোক, অন্যথায়, তাঁদের উৎপাদিত গোবিন্দভোগ লেভি হিসেবে নিয়ে ও তার বেশি দাম দিয়ে তাঁদের লোকসান ঠেকানো হোক।
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “গোবিন্দভোগ উৎপাদকদের কাছ থেকে চাল নিয়ে বিনিময়ে তাদের কোথাও থেকে সেদ্ধ চাল দেওয়া যায় কি না, তার চেষ্টা হচ্ছে। তবে ওঁদের উৎপাদিত চালের জন্য বেশি দাম দেওয়া সম্ভব নয়। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া যে দামে আতপ চাল কেনে, সেই দামই ওঁরা পেতে পারেন।” |