সাত সকালেই শহরের নানা দিকে সাইরেনের শব্দে যেন ঘুম ভেঙেছিল শিলিগুড়িবাসীর। অহরহ বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলেছে অজস্র লালবাতি লাগানো গাড়ি। বেলা বাড়তেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় শুরু হয়ে যায় ট্রাফিক পুলিশের যান নিয়ন্ত্রণ। কখনও এ দিক দিয়ে যাওয়া মানা, তো কখনও ওদিক দিয়ে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ কর্মীদের সঙ্গেই সিভিক পুলিশের নজরদারি। কলকাতায় মহাকরণ বা নবান্ন এলাকায় যাঁরা গিয়েছেন, তাঁদের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু শিলিগুড়ির অনেকের কাছেই নতুন।
মঙ্গলবার শহর লাগোয়া রাজ্য সরকারের শাখা সচিবালয়ে উত্তরকন্যায় রাজ্য মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী-সহ ৩১ জন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে সোমবার রাত থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল, পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে সাজসাজ রব। আর তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এ দিন। সকালে ট্রেন, বিমানে বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী, প্রধান সচিব-সহ আমলাদের আসা শুরু হয়। আর তাতেই বদলে যায় শহরের ছবিটা। সার্কিট হাউস, পূর্ত দফতরের বাংলোর পাশাপাশি বিভিন্ন হোটেলের সামনেও পুলিশের পাইলট ভ্যানের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন রাস্তার খোলা অংশে নাইলনের রশি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। |
বেলা বাড়তেই ৩১-ডি জাতীয় সড়ক, হিলকার্টরোডে শুরু হয় যান নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি। দুপুর ২টা নাগাদ কলকাতা থেকে বিমানে বাগডোগরা বিমানবন্দরে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগেই ফুলবাড়ির দিক থেকে জাতীয় সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। তেমনই বন্ধ হয়ে যায় মহানন্দ সেতু থেকে হিলকার্ট রোডে ঢোকা এবং বার হওয়ার একটি অংশ। বিষয়টি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের অনেক কর্মীদের ক্ষোভ জানাতে দেখা যায়, গাড়ির চালকদের। ‘এত ‘ভিভিআইপি’ চারদিকে ঘোরাফেরা করছেন, একটু সমস্যা তো হবেই। আজকে দিনটা মানিয়ে নিন, ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে’-এমনটাই বলতে শোনা যায় ট্রাফিক পুলিশ কর্মীদের।
দুপুর দেড়টা নাগাদ সাইরেনের শব্দ পেয়েই উত্তরকন্যার সামনে জাতীয় সড়কের দু’ধারের ভিড়টা বাড়তে থাকে। ভিড় ঠেলে এগোতে থাকেন অনেকেই। সাদা বড় গাড়িটার সামনে যিনি বসে রয়েছেন, কিন্তু তিনি তো মুখ্যমন্ত্রী নন। ভিড়ের থেকেই আওয়াজ এলো, ‘উনি তো আইনমন্ত্রী। এর পরের দেড়ঘণ্টা জুড়েই শুধুই হুটারের শব্দে উৎসুক জনতা মুখ্যমন্ত্রীর আসছেন বলে ভেবেছেন, কিন্তু দেখেছেন, একের পর এক গাড়িতে মন্ত্রী ও আমলারা।
তিনটে বাজতে মিনিট দশেক আগে উত্তরকন্যার সামনে পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়। খুব ধীরগতিতে। দু‘পাশের ভিড়কে নমস্কার জানালেন সামনের আসনে বসা মুখ্যমন্ত্রী। হাততালি দিয়ে পাল্টা অভিবাদন জানাল জনতাও। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি ঢোকার পরেই, উত্তরকন্যার মূল প্রবেশ দ্বারের থেকে প্রায় দেড়শ মিটার দূরে দাড়ানো এক পুলিশ অফিসারের ওয়াকিটকিতে মন্ত্রিসভার বৈঠক শুরুর বার্তা এল, সঙ্গে নির্দেশ-কোনও গাড়িকে উত্তরকন্যায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না। |
এ দিন ভিড় সরাতে পুলিশকে হিমসিম খেতে হয়েছে। একসময় জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উৎসাহীদের সঙ্গে পুলিশ ধাক্কাধাক্কিও করে বলে অভিযোগ। পুলিশের ধাক্কায় ছিটকে যান দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র বাপ্পা সরকার। শক্তিগড়ের বাসিন্দা বাপ্পার কথায়, “এতদিন সংবাদপত্রে মন্ত্রিসভার বৈঠকের কথা শুনেছি। ঘরের এত কাছে সেই বৈঠক হচ্ছে শুনে তাই চলে এসেছি।” বিকেল চারটে নাগাদ উত্তরকন্যার সামনেই হাতে হেলমেট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন চা ব্যবসায়ী কল্যাণ রায়। বললেন, “বর্ধমান রোডের বাড়ি থেকে একের পর এক মন্ত্রীদের কনভয় যাওয়ার শব্দ পাচ্ছিলাম। আর বাড়িতে থাকতে পারলাম না। শেষ অবধি থাকব।”
শুধু আগ্রহী বা অত্যুৎসাহীরাই নয়, অভাব-অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন অনেকে। ভক্তিনগর এলাকার বাসিন্দা তিনজনেই একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক সংস্থার এজেন্ট ছিলেন। তাঁদের একজন পুষ্পা সরকারের কথায়, “নবান্নের মত উত্তরকন্যাতেও মন্ত্রীরা বসবেন শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। তাই এ দিন দেখতে এলাম। সারদা কাণ্ডের পরে আমরা খুবই বেকায়দায় রয়েছি। আজ তো পারলাম না, আগামী সপ্তাহেই উত্তরকন্যায় এসে অভিযোগ জমা দিয়ে যাব। এ দিন এসে নিজের চোখে সবকিছু দেখে গেলাম।” |