‘মিনি মহাকরণ’কে জেলায় নিয়ে যাওয়া আগেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গে নিজের শাখা সচিবালয় ‘উত্তরকন্যা’কে শুধু উত্তরবঙ্গের প্রত্যাশা মেটানোর জায়গায় আটকে রাখলেন না মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার, সেখান থেকে গোটা রাজ্যের নিরিখে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ (কাটোয়ায় এনটিপিসি-র বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সরকারি জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত, যার অন্যতম) ঘোষণা করে নবান্নের সঙ্গে প্রায় একই সারিতে যেন ‘উত্তরকন্যা’কে বসালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন নবনির্মিত প্রেস কর্নারে বলেন, “বিধানসভা ভোটের আগে উত্তরবঙ্গে শাখা সচিবালয় গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন বছরের আগেই তা করেছি। উদ্বোধনও হয়েছে। এ বার সেখানে মন্ত্রিসভার বৈঠক হল। উত্তরবঙ্গ শুধু নয়, গোটা রাজ্যের নানা উন্নয়ন প্রকল্প, নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাসও হল। আমরা কথা রেখেছি। কথা রাখাটা একটা বড় কাজ।” তাঁর সংযোজন, “ইদানীং মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে নবান্নে আমি
নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করি
না। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষকে
আমি খুব ভালবাসি। উত্তরবঙ্গের ব্যাপারটা আমার কাছে একদম অন্য রকম। সে জন্য নিজেই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত জানালাম।”
শাখা সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক ঘিরে কৌতুহল ছিল তুঙ্গে। সোমবার থেকেই শিলিগুড়িতে মন্ত্রী-আমলারা পৌঁছতে শুরু করেন। এ দিন দুপুরের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী-সহ ৩১ জন মন্ত্রী শিলিগুড়ি পৌঁছে যান। শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোড, বর্ধমান রোড লাল-বাতির গাড়িতে ছয়লাপ হয়ে যায়। ‘উত্তরকন্যা’র সামনে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলা থেকে কয়েক হাজার কৌতুহলী মানুষ ভিড় করেন। একের পর এক মন্ত্রীর গাড়ি ‘উত্তরকন্যা’র গেটে পৌঁছতে অত্যুৎসাহীরা সমস্বরে স্বাগত জানান তাঁদের। |
বেলা পৌনে ৩টে নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছন। তিনি ৩০ জন মন্ত্রী, মুখ্য সচিব-সহ অন্য আমলাদের নিয়ে কনফারেন্স হলে ঢুকে যান। প্রায় আধ ঘণ্টা বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী কাটোয়ার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমি দেওয়ার বিষয়টি প্রথমে উল্লেখ করেন। এর পরে উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা হেল্থ ডিরেক্টরেট, পরিবহণ দফতরে আরও নিয়োগ, মাদ্রাসার শিশু শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে সরকারি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের আওতায় আনা-সহ একাধিক সিদ্ধান্ত অনুমোদনের কথা ঘোষণা করেন। তবে ‘উত্তরকন্যা’ চালু হলেও যথেষ্ট সংখ্যক কর্মী ও অফিসার
না থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ
করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “এমনিতেই আমাদের অফিসার-কর্মী কম। তবুও প্রথম পর্যায়ে কিছু অফিসার-কর্মী উত্তরকন্যায় নিযুক্ত হয়েছেন। আরও দরকার। আগামী বছরই আরও আইএএস-আইপিএস অফিসার পাওয়া যাবে। উত্তরকন্যায় আমার দফতরে এক জন আইএএস অফিসার দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
শুধু ‘উত্তরকন্যা’ গড়া বা চালু করার জন্য নয়, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বারবার চলে আসায় রাজ্যের মানচিত্রে উত্তরবঙ্গ যে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে, সে কথা ঘনিষ্ঠ মহলে মানছেন একাধিক বিরোধী দলের নেতা। কংগ্রেসের জেলা স্তরের এক প্রবীণ নেতা জানান, অতীতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে মালদহে এক বার মন্ত্রিসভার বৈঠক হওয়ার পরে, বিপুল সাড়া মেলে জনতার। এ বার শাখা সচিবালয় পুরোদস্তুর চালু হলে উত্তরবঙ্গের ‘বঞ্চিত ও অবহেলিত’ তকমা মুছে দিতে অনেকটাই সফল হবেন তৃণমূল নেত্রী। তবে দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর মালাকারের প্রতিক্রিয়া, “এ দিনের ঘোষণা আগামী দিনে কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা-ও
দেখা দরকার।”
কোচবিহার ও ডুয়ার্সে বামফ্রন্টে সিপিএমের শরিক দলের একাধিক নেতার বক্তব্য, তাঁরাও এক সময়ে উত্তরবঙ্গে ‘মিনি মহাকরণ’ তৈরির দাবি তুলেছিলেন। বড় শরিকেরা গুরুত্ব দেননি। তাঁদের আক্ষেপ, বাম আমলে এই মিনি মহাকরণের কাজটা কিছুটা এগোলে, হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। পক্ষান্তরে, সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা হেলথ ডিরেক্টরেট করাটা ভাল পদক্ষেপ। বুনিয়াদপুরের পুরসভার মর্যাদা পাওয়াটা ভাল ব্যাপার। তবে অন্য সব কটি পুরসভার অনুমোদন হওয়া জরুরি।” এর পরেই প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর কটাক্ষ, “এ সব সিদ্ধান্ত কলকাতায় বসেই নেওয়া যেত। সে জন্য বহু কোটি টাকা খরচ করে উত্তরকন্যা গড়ার দরকার ছিল না। লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলের পালে বাতাস কাড়তে সরকারি টাকা খরচ করা হচ্ছে।” |
উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য বলেছেন, “উত্তরবঙ্গ যে অবহেলিত ও বঞ্চিত নয়, তা এর আগে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর গড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ধারাবাহিকতা রেখেই তাঁর নির্দেশে গড়ে উঠেছে উত্তরকন্যা। এটা উত্তরবঙ্গের মানুষের আবেগের জায়গা। এই আবেগকে কেউ আঘাত করা মানে উত্তরবঙ্গের মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়া।” মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে উত্তরবঙ্গে অনেক মহলেই যে আবেগ আছে, সে কথা অবশ্য অস্বীকার করতে পারছেন না বিরোধীরাও। আজ, বুধবারই মালবাজারে আদিবাসীরা তাঁদের সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান ‘সানগি
দাই’ তথা বীরাঙ্গনা সম্মান
দেবেন মুখ্যমন্ত্রীকে।
|