মমতার বিরুদ্ধে মুখ খুললেন মমতা। কিন্তু অভিযোগ, তার মধ্যে রয়ে গেল রাজনীতির কাঁটা।
লাভপুরের নিগৃহীতার সঙ্গে দেখা করতে মঙ্গলবার রাজ্যে এসেছিল জাতীয় মহিলা কমিশন। তার চেয়ারপার্সন মমতা শর্মা কড়া ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকার সমালোচনাও করলেন। এ দিন দমদম বিমানবন্দরে নামার পরই কমিশনের প্রতিনিধি দলে যোগ দেন সিপিএম নেত্রী, প্রাক্তন সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্য। কোন পদাধিকারে মালিনী ওই দলের সঙ্গে থাকলেন সেই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি মমতা শর্মার বক্তব্যেও রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তৃণমূল।
মঙ্গলবার সকালে কলকাতায় পা রাখেন মমতা শর্মা ও মহিলা কমিশনের এক সদস্য শামিমা সফি। বিমানবন্দর থেকে তাঁদের সিউড়ি যাওয়ার কথা ছিল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে সেখানেই একটি হোমে রয়েছেন লাভপুরের নির্যাতিতা যুবতী। তার আগে বিমানবন্দরেই চার বাম দলের মহিলা সংগঠনের প্রতিনিধিরা রাজ্যে পরপর নারী নিগ্রহের ঘটনায় কমিশনের হস্তক্ষেপ দাবি করে স্মারকলিপি দিতে যান। সেই দলেই ছিলেন সিপিএম নেত্রী মালিনী ভট্টাচার্য। |
জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য হওয়ার সুবাদে মালিনী এবং মমতা পূর্ব-পরিচিত। মালিনীকে কমিশনের গাড়িতে তুলে নেন মমতা। রাতে মালিনী আনন্দবাজারের কাছে দাবি করেন, তাঁর যাওয়াটা মোটেই পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। মমতা ‘গণতান্ত্রিক মনোভাব’ থেকে প্রস্তাব দেওয়াতেই তিনি গিয়েছেন। মালিনীর বক্তব্য, “আমি দীর্ঘদিন ধরে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যও ছিলাম আগে। ওঁদের সঙ্গে যাওয়ায় অপরাধটা কী হয়েছে, বুঝছি না।” তৃণমূলের পাল্টা বক্তব্য, মালিনী তো মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য হিসেবে মমতা শর্মার সঙ্গে দেখা করতে যাননি। গিয়েছিলেন, নিজের রাজনৈতিক সংগঠনের তরফেই। তাই এই যুক্তি খাটে না।
শামিমা সফি এবং মালিনীকে নিয়ে প্রথমে সিউড়ি গিয়ে লাভপুরের নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করেন মমতা। সেখানে বীরভূমের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা এবং পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াও ছিলেন। তার পর রাতে উলুবেড়িয়া হাসপাতালে গিয়ে আমতায় ধর্ষিতা দুই গৃহবধূর সঙ্গেও দেখা করেন মমতা। মালিনী তখনও তাঁর সঙ্গেই ছিলেন।
মমতা শর্মা এ দিন রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে শুরু করেছিলেন বিমানবন্দরে নামার পরেই। বাম নেত্রীরা স্মারকলিপি দিয়ে তখন ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে। মমতা বলেন, “এটা খুবই দুঃখের যে, বাংলায় নারী নিগ্রহ হঠাৎই খুব বেড়েছে। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এক জন মহিলা। তাঁর কাছ থেকে মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আরও কড়া নজরদারি প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার যা করার, সবটা করছে না।” রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা অবনতি হয়েছে এবং সরকার এ বিষয়ে জাতীয় মহিলা কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশই উপেক্ষা করছে বলেও অভিযোগ করেন মমতাদেবী। |
দু’বছর আগে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনাকে ‘সাজানো’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই প্রসঙ্গ টেনে এ দিন মমতাদেবী বলেন, “সরকারকে হেয় করতে কিছু সাজানো হয়নি। বাংলায় মহিলাদের প্রতি অপরাধ যে বেড়েই চলেছে, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো ইতিমধ্যেই সে কথা বলেছে।”
মমতা শর্মার এই অভিযোগকে অবশ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। মালিনীর উপস্থিতিকেই এ ক্ষেত্রে তাঁরা সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এ দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য উত্তরবঙ্গে ছিলেন। সেখানে মমতা শর্মার বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা কোনও ব্যাপার নয়। ওরা (জাতীয় মহিলা কমিশন) সিপিএমের এক জন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।” সূত্রের খবর, মমতা ঘনিষ্ঠ মহলে এই অভিযোগও তুলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার মুজফ্ফরনগর বা অন্য অনেক জায়গাতেই নারী নিগ্রহের ঘটনায় প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা দেখায়নি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রতিনিধি দল পাঠানো হচ্ছে এবং তারাও উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই আগে থেকে তৈরি করে নেওয়া কিছু ধ্যানধারণা থেকে কথা বলছে। |
কলকাতায় তৃণমূল মুখপাত্র তথা রাজ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক মহুয়া মৈত্র বলেন, “এটা (কমিশনের এ দিনের কর্মকাণ্ড) ঘটনার তদন্ত নয়। সিপিএম এবং কংগ্রেসের রাজনৈতিক অভিযান।” তাঁর অভিযোগ, মমতা শর্মা নিজে কংগ্রেসের লোক। ২০১১ সালে তিনি রাজস্থান মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রীর পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পরে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন হন কংগ্রেসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করতেই তাঁকে পাঠানো হয়েছে বলে মন্তব্য করে মহুয়ার অভিযোগ এ দিনের সফর তালিকায় মালিনীদেবীর নাম ছিল না। মালিনী বর্তমানে রাজ্য বা জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যও নন। তা সত্ত্বেও চেয়ারপার্সন তাঁকে সঙ্গে নিয়েছেন।
এ দিন কমিশনের সঙ্গে রাজ্যের সমাজকল্যাণ সচিব রোশনী সেন এবং ডিজি জি এম পি রেড্ডিরও দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা একটা সময় অবধি অপেক্ষা করে ফিরে যান।
সিউড়ি এবং উলুবেড়িয়ায় নির্যাতিতাদের কথা বলে মমতা অবশ্য জানিয়েছেন, পুলিশ বা হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঁরা কেউই অভিযোগ করেননি। রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভেঙে পড়েছে, তা আবারও জোর দিয়ে দাবি করেন মমতা। প্রধানমন্ত্রীকে সব রিপোর্ট দেবেন বলেও জানান তিনি। |