এখনও এলাকার পাঁচ-পাঁচটি কারখানায় তৃণমূল-সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি তিনি। কলকাতা পুরসভার ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ড অফিসে সপ্তাহে চার দিন সকালে বসেন। এই চার দিনই জনা পঁচিশেক মানুষ বসে থাকেন তাঁর অপেক্ষায়। বাড়ির লাগোয়া নিজের অফিসে প্রায় রোজই সন্ধ্যায় এলাকার লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি।
তিনি গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাভাই। পুলিশকর্মী তাপস চৌধুরী খুনের পরে বিহারের দেহরি-অন-সোন থেকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল তাঁকে। রাজনৈতিক নানা চাপান-উতোরের পরে জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে হারাতে হয়েছে ১৫ নম্বর বরো চেয়ারম্যানের পদ। তবে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে এলাকার লোকজন নানা সমস্যা নিয়ে রোজই দ্বারস্থ হন মুন্নাভাইয়ের কাছে।
বছরখানেক আগেও বরো অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ভিড় করে থাকতেন এলাকার বহু মানুষ। মুন্নাভাইয়ের কথাকেই তখন শেষ কথা বলে মানা হত গার্ডেনরিচ অঞ্চলের। এলাকায় বহুতল নির্মাণই হোক বা কারখানায় ঠিকাকর্মী নিয়োগ মুন্নাভাইয়ের দাপটে ওই সময়ে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত বলে এলাকার মানুষ জানিয়েছেন। |
কিন্তু হরিমোহন ঘোষ কলেজের ঘটনার পরে মুন্নার মাথার উপর থেকে তাঁর দলের শীর্ষ নেতাদের হাত উঠে গিয়েছে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরেও কোনও শীর্ষ নেতাকেই মুন্নার পাশে দেখেননি এলাকার মানুষ। গত রমজান মাসে গার্ডেনরিচে ইফতার পার্টিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেক নেতাই এসেছিলেন। ওই ইফতার পার্টির অন্যতম মূল সংগঠক ছিলেন মুন্না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী-সহ কোনও নেতাই মুন্নার সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত করেনি বলে এলাকার তৃণমূল নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক ভাবে কিছুটা কোণঠাসা হলেও মুন্নাভাই কি তবে শক্তিহীন হয়ে পড়েছেন? স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, বিরোধী শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের অনেকেই অবশ্য তা বলছেন না। বরং তাঁদের বক্তব্য, বকলমে মুন্নাভাই-ই এখনও এলাকাটি নিজের দখলে রেখেছেন। বরো চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হারানোর পরে নিজেকে কিছুটা আড়ালে রেখে সঙ্গীদের সাহায্যে নতুন করে বেশ কিছু এলাকার দখলও নিয়েছেন তিনি। তবে থানায় গত ক’মাসে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি বলে পুলিশের একাংশ জানিয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, বরো চেয়ারম্যান থাকাকালীন এলাকায় অবৈধ নির্মাণ-সহ নানা কাজে স্থানীয় থানা ও প্রশাসনের কর্তাদের কাছে দলবল নিয়ে গিয়ে দরবার করতেন মুন্না। এখন আর সশরীরে কোথাও মুন্নার দেখা পাওয়া যায় না। তৃণমূলের সব অনুষ্ঠানেও হাজির থাকেন না তিনি। কোনও অভিযোগ জানানোর প্রয়োজন হলে মুন্নার ঘনিষ্ঠরাই থানা বা প্রশাসনিক দফতরে যান।
শক্তিহীন না হলেও মুন্না যে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন, তা স্বীকার করেছেন তাঁর প্রতিপক্ষ কংগ্রেস নেতা মোক্তার আহমেদও। তিনি বলেন, “মুন্না এখন অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছে। তবে ও পুরোপুরি রাজনীতি ছাড়তে পারবে না। কারণ, দল ছাড়লেও পুলিশ ওকে ছাড়বে না।” সিপিএম নেতারা অবশ্য মনে করছেন, মুন্নাভাইয়ের এই গুটিয়ে থাকাটা সাময়িক। সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা গার্ডেনরিচের শ্রমিক নেতা দিলীপ সেন বলেন, “দলের সঙ্গে সব সর্ম্পকই রয়েছে। সময় হলেই ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে মুন্না।”
এ ব্যাপারে কী বলছেন মুন্নাভাই? মঙ্গলবার বাড়ি লাগোয়া অফিসে বসে মুন্না বলেন, “আমি মূলত সমাজসেবী। মানুষের বিপদে পাশে থাকতে চাই। আমার ব্যবসা রয়েছে। রাজনীতি করে টাকা উপায়ের পরিকল্পনা আমার কোনও দিনও ছিল না, এখনও নেই।” ফের তিনি পুর-নির্বাচনে লড়বেন? প্রসঙ্গ এড়িয়ে মুন্না বলেন, “আমার বিপদের সময়ে পরিবার ছাড়া কেউ পাশে ছিল না। তাই পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
এক বছর আগের সেই তেজ আর নেই মুন্নাভাইয়ের গলায়! |