চিরন্তন রায়চৌধুরী ও দীক্ষা ভুঁইয়া |
দোষীদের দ্রুত শাস্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বছর ঘুরলেও এখনও বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন মিনতি চৌধুরী।
ঠিক এক বছর আগে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের নির্বাচনী হিংসায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামী, কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী। এক বছর পরেও বিচার না পেয়ে মিনতিদেবীর প্রশ্ন, “যাদের জন্য আমার সর্বনাশ হল, তারা কী করে বাইরে ঘুরছে?” সুবিচার পেতে এখন তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ভরসা তাঁর।
বেহালার সারদাপল্লির বাড়িতে বসে বছরখানেক আগের ঘটনার স্মৃতিতে ডুবলেন মিনতিদেবী। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী আমার বাড়িতে এসে দ্রুত বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রশাসনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছি। মেয়ের চাকরিও হয়েছে। কিন্তু দোষীরা তো এখনও শাস্তি পেল না!” তা হলে কি রাজ্য সরকারের উপরে আস্থা হারিয়েছেন? মিনতিদেবী বলেন, “আত্মীয়-বন্ধুদের অনেকে বলছেন, আমি কেন সিবিআই তদন্ত চাইছি না? কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর উপরে ভরসা রয়েছে বলেই এখনও ওই পথে এগোতে চাইছি না। মহাকরণে ওঁর অফিস থাকলে এত দিনে চলে যেতাম। একা নবান্নে যাওয়ার সাহস পাই না।” |
তাপসবাবুর ছবি হাতে স্ত্রী মিনতি চৌধুরী। সঙ্গে ছেলে তমাল। মঙ্গলবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য। |
গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলা নিয়ে গোলমাল শুরু হয় হরিমোহন ঘোষ কলেজে। লড়াইটা ছিল ছাত্র পরিষদ এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মধ্যে। কলেজের গণ্ডি ছাড়িয়ে গোলমাল ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। একের পর এক বোমা পড়তে থাকে। চলে গুলিও। দুষ্কৃতীর বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু হয় তাপসবাবুর। বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে পড়ে শাসক দলের কাউন্সিলর এবং বরো চেয়ারম্যান ইকবাল ওরফে মুন্নাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় পুলিশ। সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার হন কংগ্রেস নেতা মোক্তার। পরে ঘটনার তদন্তভার যায় সিআইডি-র হাতে।
বর্তমানে মুন্না ও মোক্তার দু’জনেই জামিনে মুক্ত। সংবাদমাধ্যম থেকে সে খবর জেনেছেন মিনতিদেবী। ঘটনার এক বছর পরে নিজের বাড়িতে বসে তিনি বললেন, “ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী বাড়িতে এসে আশ্বাস দিয়েছিলেন, এক মাসের মধ্যেই অভিযুক্তেরা শাস্তি পাবে। কিন্তু এখনও সেই মামলা আদালতেই ওঠেনি।” মামলার অগ্রগতি জানতে গত সপ্তাহে সিআইডি-র অফিসে ফোন করেছিলেন মিনতিদেবী। সিআইডি অফিসারেরা তাঁকে জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা।
তদন্তকারীরা আশ্বাস দিলেও এক বার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন মিনতিদেবী। সামনাসামনি দেখা হলে তাঁর কাছে জানতে চাইবেন, অভিযুক্তেরা কবে শাস্তি পাবে? তাপসবাবুর পরিবার সূত্রে খবর, স্বরাষ্ট্রসচিবকে চিঠি পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় চাওয়ার তোড়জোড় করছেন মিনতিদেবী।
তবে, গার্ডেনরিচের ঘটনার পরে কলেজ নির্বাচন নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের ঢিলেঢালা ভাব এখন বদলেছে বলে মনে করেন মিনতিদেবী। তাঁর বক্তব্য, “অতীত থেকে সবাই শিক্ষা নেয়। কলেজের ভোটে এখন কত পুলিশ থাকে। অথচ, ওঁকে (তাপসবাবু) নিরস্ত্র অবস্থায় ডিউটি করতে হয়েছিল। ঝামেলার মধ্যে পড়ে প্রাণটাও গেল।”
তাপসবাবুর মৃত্যুর এক বছর পরে কেমন আছে তাঁর পরিবার?
রাত জেগে কলেজের ‘প্র্যাক্টিক্যাল’ পরীক্ষার খাতা তৈরি করেছেন তাপসবাবুর মেয়ে তনুশ্রী। বাবার মৃত্যুর পরে কলকাতা পুলিশে চাকরি পেয়েছেন তিনি। মিনতিদেবী বলেন, “সব কিছু কেমন বদলে গেল। মেয়েটার কি এখন কলেজ ছেড়ে অফিস যাওয়ার বয়স? পড়াশোনার সময় পায় না। অনার্সটা হয়তো আর থাকবে না!” সামনের বছরই মাধ্যমিকে বসবে মিনতিদেবীর ছেলে তমাল। বছর ষোলোর ওই কিশোর বলে, “বাবার ইচ্ছে ছিল, মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করলে পলিটেকনিক পড়াবে। সেটাই এখন প্রাণপণে চেষ্টা করছি।”
১২ ফেব্রুয়ারিই জন্মদিন ছিল তাপসবাবুর। এ বছর ওই দিনই তাঁর মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হবে। মিনতিদেবী বললেন, “দিনটা আমাদের চোখের জলেই কাটবে।” |