ট্রেন ছাড়তে তখন বাকি আর মাত্র এক মিনিট। মুখে হুইসল, হাতে সবুজ আলো নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে গার্ড। আচমকা হইচই। প্যান্ট্রিকারের কর্মীরা ট্রেন থেকে নেমে ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছেন গার্ডের দিকে। কয়েক জন ছুটে গিয়েছেন চালকের কেবিনের দিকে। হাওড়া-নয়াদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের পরের কামরটি (পাওয়ার কার) থেকে গলগল করে বেরনো ধোঁয়া তত ক্ষণে নজরে এসেছে গার্ডের। ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বাজেনি। প্ল্যাটফর্মে নেমে ছোটাছুটি করতে থাকেন যাত্রীদের অনেকেই।
মঙ্গলবার বিকেলের ঘটনা। হাওড়া স্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা ছিল বিকেল ৪টে ৫৫ মিনিটে। তার ঠিক এক মিনিট আগেই ধরা পড়ল আগুন। হাওড়া স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে যদি এই আগুন লাগত, তা হলে যে কী হত, তা ভাবতেই শিউরে উঠছেন রেল-কর্তারা। আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় দমকলের তিনটি ইঞ্জিন। এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন আয়ত্তে আসে। এই ঘটনার জেরে এ দিন ট্রেনটি ছাড়তে দেড় ঘণ্টারও বেশি দেরি হয়েছে। |
ধোঁয়ায় ঢেকেছে রাজধানী। মঙ্গলবার দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি। |
কী ভাবে আগুন ধরল, তা রাত পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, শর্ট সার্কিট থেকেই প্রথমে আগুন ধরে পাওয়ার কারের একাংশে। ওই কামরাটিতে কিছুটা জায়গা মাল রাখার জন্য নির্দিষ্ট। দমকল ও রেল সূত্রে খবর, ওই মালপত্রের মধ্যে কয়েকশো প্যাকেট সিগারেট, জামাকাপড়, ওষুধ ইত্যাদি ছিল। ছিল প্লাস্টিকের মতো দাহ্যবস্তুও। অনুমান, ওই জায়গাতেই আগুন লাগে। এই ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী।
যে কামরায় আগুন লাগে তার পিছনেরটি প্যান্ট্রিকার। তার পরেই বি-১ কামরা। ওই কামরার যাত্রী তপন বণিক, শঙ্করদাস নাগেরা বলেন, “দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম। আচমকাই ধোঁয়ায় চার দিক ঢেকে যায়। সঙ্গে তীব্র কটু গন্ধ। তার পরেই প্যান্ট্রির কর্মীদের ‘আগুন আগুন’ চিৎকার শুনে বুঝতে পারি কী হয়েছে।”
হাওড়ার মতো ব্যস্ত স্টেশনে আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে রাজধানীর মতো ট্রেনে আগুন ধরে যাওয়ায় যাত্রীদের সঙ্গে রেলকর্মীরাও হতচকিত হয়ে পড়েন। দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখটি দড়ি দিয়ে আটকে দেয় আরপিএফ। কিন্তু লোকের চাপে ওই ব্যারিকেড এক সময় খুলে যায়। অগ্নিদগ্ধ কামরার সামনে গিয়ে দেখা যায়, রেললাইন ও প্ল্যাটফর্মে চারদিকে আধপোড়া সিগারেটের প্যাকেট, ওষুধ রাখার প্লাস্টিকের শিশি পড়ে আছে। প্লাস্টিক পোড়া গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। টিকিয়াপাড়া থেকে আর একটি পাওয়ার কার এনে রাজধানী ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ।
রেলকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছেন যাত্রীরা। রাজধানীর মতো ট্রেন ছাড়ার পরে সামনের কামরায় আগুন ধরে গেলে পিছনের দিকের কামরাগুলিতে তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারত। তা ছাড়া রাজধানী দাঁড় করাতেও প্রায় তিন কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করতে হয়। তাতে দুর্ঘটনা আরও ভয়াবহ হতে পারত।
কী করে লাগেজ ভ্যানে সিগারেট ও প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল? হাওড়ার ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার অনির্বাণ দত্ত বলেন, “রাজধানীর ওই মাল রাখার জায়গাটি এখন বেসরকারি সংস্থাকে ভাড়া দেওয়া রয়েছে। তারা কী করে দাহ্যবস্তু নিয়ে যাচ্ছিল, তা তদন্ত করা হচ্ছে।” ওই সংস্থাকে এ দিনই কালো তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে পূর্ব রেল।
ট্রেনে আগুন ধরার ঘটনা ঠেকাতে গত মাসের ২১-২২ তারিখে রেল বোর্ড প্রতিটি জোনের জেনারেল ম্যানেজারদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছিল। তাতে সব জোনকেই এ ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক হতে বলা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও যে কোনও পরিবর্তন হয়নি তা এ দিনের ঘটনাতেই প্রমাণিত। রেলের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর বলেন, “হাওড়ায় এ দিন যা ঘটেছে তা খুবই মারাত্মক। রেলকর্মীদের অবিলম্বে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।” |