মধ্যবিত্তের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
যারা ভাবছেন, দেবের সঙ্গে সিংহের লড়াই দেখার পর জিৎ বনাম বাঘমামার যুদ্ধ দেখতে পাবেন— তাঁদের বলছি, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সে ছবি নয়। এখানে জিৎই বাঘের রোলে বাঘ মানে, মানুষ-বাঘ। বাঘা মেজাজের মানুষ যাকে বলে আর কী!
জিৎ বাঘা হলে আবির কি গুপি? না না, আবিরও বাঘা। মানে আবিরকে বাঘা বানিয়ে তোলে জিৎ, আবিরের ফ্রেন্ড, ফিলোজফার, গাইড। তার অনুপ্রেরণাতেই কেঁচো আবিরের ব্যাঘ্রাবতার! আর সেটাই হচ্ছে গল্প। গল্প এবং চিত্রনাট্য দুইই নীরজ পাণ্ডের।
নীরজ পাণ্ডেকে চিনতে পারছেন নিশ্চয়। ‘আ ওয়েডনেসডে’, ‘স্পেশাল ছাব্বিশ’ যাঁর বানানো, সেই নীরজ পাণ্ডে। মুম্বইয়ের প্রযোজনা সংস্থা ভায়াকম ১৮-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনিই বাংলায় এলেন, বাংলার বাঘের গল্প বলতে। সুস্বাগতম!
এ বার গল্পের কথায় আসি। গল্পের কথায় সব সময়ই দুটো ব্যাপার থাকে। এক, গল্পটা কেমন। আর দুই, গল্পটা কেমন করে বলা হল। সিনেমার ক্ষেত্রে এই কেমন করে বলা হল-র পর্বটা চিত্রনাট্য থেকেই শুরু হয়। তার পর ক্যামেরা, সম্পাদনা, অভিনয়, সঙ্গীত এবং সামগ্রিক ভাবে পরিচালকের (রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়) মুন্সিয়ানার দিকগুলো আসে। সেই দিক থেকে রয়্যাল বেঙ্গল অবশ্যই সুলিখিত, সুপরিচালিত। গোছানো চিত্রনাট্য, গোছানো পরিচালনা। বাড়তি মেদ নেই বললেই চলে। অভিরূপ আর অপর্ণার সংসারের মতোই। বাহুল্যও নেই, টানাটানিও নেই।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
বোঝা গেছে আশা করি, আবিরের নামই অভিরূপ। আর অপর্ণা, প্রিয়াঙ্কা। ওদের একটা ছেলেও আছে। এমনিতে নির্ঝঞ্ঝাট গেরস্থালি। শুধু কয়েকটা সমস্যা ছাড়া। যেমন ভাড়াটে পাকড়াশীকে (খরাজ মুখোপাধ্যায়) বলে বলেও টাকা আদায় হয় না। যেমন স্কুলবাসের জন্যে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে রোজ অভিরূপের ছেলের সঙ্গে আর একটা গাট্টাগোট্টা বাচ্চার খিটিমিটি। যেমন, মেট্রো স্টেশনে অভিরূপের সামনেই ওর কলিগ নন্দিনীর (শ্রদ্ধা দাস) হেনস্থা। যেমন, অফিসে ফাইলপত্র গায়েব করে, ডাটা গুবলেট করে দিয়ে অভিরূপকে দীপঙ্করের লেঙ্গি মারা। সব কিছুই মুখ বুজে সহ্য করে অভি। এই মানুষটাই এক দিন পাল্টে যায়। তাকে পাল্টে দেয় তার বন্ধু অঞ্জন। মানে, জিৎ।
আবির আর জিতের জুটি এই প্রথম পর্দায় এল। আলাদা করে দেখলে দু’জনেই ভাল করেছেন। এই প্রথম ভিন্ ধারার ছবিতে জিতের আত্মপ্রকাশ, এই প্রথম তাঁর মুখে নজরুলের কবিতা। জিৎ-ভক্তদের জন্য অবশ্যই সুখবর। জিৎ-আবির দুজনকে একসঙ্গেও খারাপ লাগেনি। তবে হাফপ্যান্ট পরা বয়সের অভিন্নহৃদয় বলেও মনে হয়নি।
এমনিতে জিৎকে এখানে খুব বেশি কিছু করতে হয়নি। তাঁর ভূমিকাটা রিং মাস্টারের। প্রধান খাটনিটা ছিল আবিরের। ভাল করেছেন। বিশেষ করে ভিতু অবতারে তাঁর বডি ল্যাংগুয়েজ বেশ ভাল। কিন্তু গোটা ছবিটা কাঁধে নিয়ে চলতে গেলে এর পরেও একটা এক্স-ফ্যাক্টর লাগে। সেটা তাঁকে আয়ত্ত করতে হবে। এইখানে কিন্তু কয়েক কদম এগিয়ে আছেন প্রিয়াঙ্কা। যত ক্ষণ ফ্রেমে আছেন, অন্য দিকে তাকাতে দিচ্ছেন না।
তবে এ ছবির যেটা বড় গুণ, প্রত্যেকটি চরিত্র— তাদের চেহারা, পোশাকআশাক, ভাবভঙ্গির মধ্যে একটা পরিমিতি আছে। অযথা গ্ল্যামারাইজ করার চেষ্টা নেই। বেশি সুন্দর, বেশি ঝকঝকে হয়ে ওঠার দায় নেই।
ইদানীং সিনেমায় জামাকাপড়-ঘরবাড়ি এত বেশি ‘সিনেমার মতো’ করে দেখানো হয় যে তাকে ইন্টিরিয়র ডেকর-এর বুকলেট বলে মনে হতে বাধ্য। এই ছবিটা তার পাশে বেশ আলাদা। ঘরবাড়ি, অফিস, রেস্তোরাঁ, সর্বত্রই একটা মধ্যবিত্ততার ছাপ আছে। প্রোডাকশন ডিজাইনের নিরিখে অতএব এ ছবিকে অনেকটা এগিয়ে রাখতে হচ্ছে। আবিরের ভাড়াটে পাকড়াশীর ঘরের দেওয়ালে যে হটওয়াটার ব্যাগটা ঝুলতে দেখা যায়, সেটা না থাকলে গল্পের কোনও ক্ষতি হয়তো হয় না। কিন্তু ওটা আছে বলেই স্পেসটা অনেক বেশি ঘনত্ব পায়। ইদানীং থিমপুজো ধাঁচের শিল্প নির্দেশনা দেখতে অভ্যস্ত চোখে এটা বেশ ভাল লাগল।
কিন্তু মূল সমস্যাটা থেকে গেল মূল গল্পেই। স্টুপিড কমন ম্যানের (হাল আমলে যাকে আম আদমি বলা হচ্ছে) রুখে দাঁড়ানোর কাহিনি নীরজের প্রিয় থিম। তার সঙ্গে উনি একটা সাইকোলজিকাল ডিসঅর্ডারের গল্প জুড়েছেন। আর সেটাতেই হয়েছে চিত্তির। ছবিটা যেখানে পৌঁছল সেটা না হল আম আদমির জেগে ওঠার স্বপ্নপূরণ, না হল ডার্ক সাইকোলজিকাল থ্রিলার। অফিস পলিটিক্সের বদলা নেওয়ার জন্য খুন? অফিসে যে তোর ফাইল গায়েব করেছে, তাকে তুই দুনিয়া থেকে গায়েব করে দে? নাহ্, এটা নেওয়া যাচ্ছে না!
নেওয়া যেত— ওই যে বললাম, যদি ছবিটা আগাগোড়া একটা ডার্ক সাইকোলজিকাল থ্রিলার হত। সে ক্ষেত্রে জেকিল আর হাইড-এর গল্প বলতে হত। অভিরূপের আত্মশক্তি (নাকি ব্যাঘ্রশক্তি) জাগরণের মহিমা কীর্তন দরকার হত না। জিৎকে দিয়ে ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি করাতে হত না। আমাদের চারপাশটা এমনিতেই এত বেশি রকম হিংস্র এখন, সেখানে এই রকম উস্কানিমূলক পপুলিজম, ভায়োলেন্সের এই রকম হাতছানি পর্দায় না এলেই ভাল। পায়ে পড়ি বাঘমামা!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.