তিনিই ছিলেন তৃণমূলের সাত্তোর ও কসবা অঞ্চলের দাপুটে নেতা। বিরোধীদের অভিযোগ, গত পঞ্চায়েত ভোটে অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী ওই নেতার নেতৃত্বেই তৃণমূলের দুষ্কৃতী দল সন্ত্রাস চালিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়নপত্র জমাই দিতে দেয়নি। তৃণমূলের সেই সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফাই এখন জেলের হাজতে। সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় অনুব্রত এবং জেলা সভাপধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর পরেই তিন নম্বরে রয়েছে সাত্তোর গ্রাম পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী এই তৃণমূল সদস্যের নাম। সোমবার দুপুরে সিউড়ি আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে প্রিজন ভ্যান থেকে চেঁচিয়ে অবশ্য দাবি করলেন, “আমি হৃদ্রোগী। আমাকে চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে।”
কে এই মুস্তফা?
দল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পাড়ুই থানার সাত্তোরের এই বাসিন্দা পেশায় ছিলেন মোষের পাইকর। আরএসপি থেকে কংগ্রেস হয়ে যোগ দেন তৃণমূলে। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই মুস্তফা দলের সাত্তোর অঞ্চলের সম্পাদক। গত ভোটে বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েতগুলিতে দলের ‘বিক্ষুব্ধ’দের প্রভাব ঠেকাতে সাত্তোর-সহ লাগোয়া কসবা অঞ্চলে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে দলীয় সূত্রে খবর। পুলিশ সূত্রের দাবি, পুলিশের খাতায় ৭টির বেশি খুনের ঘটনা, রাহাজানি, সন্ত্রাস, বাড়ি ভাঙচুর, বোমাবাজি এবং বেআইনি জমায়েত, ষড়যন্ত্র-সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে ওই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে।
বিরোধীদের অভিযোগ, এমন দাপুটে নেতার ‘সন্ত্রাসে’ই সাত্তোর পঞ্চায়েতে এ বার ভোট হয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে ছিলেন শেখ মুস্তফা। যদিও দায়িত্ব পেলেও দলের ‘মুখরক্ষা’ করতে পারেননি কসবা পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে। টিকিট না পেয়ে দলেরই বিক্ষুব্ধেরা ওই পঞ্চায়েতে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে যান। বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ ছিল, মনোনয়ন পর্ব থেকে ভোট পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বেই একাধিক প্রার্থীর বাড়িতে হামলা করা হয়েছিল। ভোটের আগের রাতে কসবা পঞ্চায়েতের বাঁধনবগ্রাম সংসদের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ খুনেও মূল অভিযুক্তদের মধ্যে তিন নম্বর তিনিই। ভোটের ফলে ওই পঞ্চায়েতে অবশ্য তৃণমূল বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। ভোটে লড়ে বর্তমানে কসবা পঞ্চায়েত বিক্ষুব্ধদেরই দখলে।
মাসখানেক আগে রীতিমতো সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে এসে মিছিল করে মুস্তফা ‘দখল’ করেছিলেন সিপিএমের অজয় লোকাল কমিটি। জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত এই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধেই সম্প্রতি এক পাট্টাদারের কয়েক বিঘে চাষজমি দখল করার অভিযোগ উঠেছিল ওই নেতার বিরুদ্ধে। পরিবারটি সুরাহার দাবিতে মহকুমাশাসকের দফতরের সামনে অনশনেও বসেছিল। এমন এক নেতা হাজতে চলে যাওয়ায় জেলা তৃণমূলের অন্দরে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা। মুস্তফা মুখে ‘চক্রান্তে’র কথা বলছেন। কিন্তু পঞ্চায়েতের এক নির্দল প্রার্থীর বাবা খুনে কেন তাঁর বিরুদ্ধেই চক্রান্ত হল, তা আর খোলসা করেননি। এমন নেতার গ্রেফতারি নিয়ে মুখ খোলেননি একই খুনে অভিযুক্ত অনুব্রত এবং জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। ফোন ধরেননি বোলপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। ফোন ধরলেও মন্তব্য করতে চাননি দলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দোপাধ্যায়ও।
এ দিনের বাকি ধৃতেরা হলেন অভিযুক্তদের তালিকায় ২৩ নম্বরে নাম থাকা প্রিয় মুখোপাধ্যায়, যথাক্রমে ২৪ ও ২৫ নম্বরে নাম থাকা জগন্নাথ দাস ও জলধর দাস। প্রথম জনের বাড়ি স্থানীয় শেহালাই গ্রামে। বাকি দু’জন বাঁধনবগ্রামেরই বাসিন্দা। প্রত্যেকেই এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলেই পরিচিত। সিউড়ির সিজেএম আদালতে সিআইডি ধৃতদের নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিল। কিন্তু সিজেএম রাজেশ চক্রবর্তী ধৃতদের দু’ দিন জেল হাজতের নির্দেশ দেন। সরকারি আইনজীবী কুন্তল চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মামলার তদন্তকারী অফিসার বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় হাইকোর্টে উপস্থিত থাকায় সিউড়ি আদালতে থাকতে পারেননি। বিচারক সিআইডি-র ওই আবেদন নামঞ্জুর করে আগামী বুধবার ফের ধৃত চার জনকে আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন।” বিচারক ওই দিনই মামলার কেস ডায়েরি নিয়ে ঘটনার তদন্তকারী অফিসারকে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশও দিয়েছেন। এ নিয়ে সাগরবাবুর হত্যায় সিআইডি পাঁচ জনকে গ্রেফতার করল।
ওই দাপুটে তৃণমূল নেতার গ্রেফতারির পরে সাগরবাবুর পরিজন অবশ্য বলছেন, “আরও বড় বড় নেতারা এখনও অধরা। সিআইডি এ বার তাঁদেরও হাজতে পুরুক।” |