যে চুল বাঁধে, সে-ই রাঁধে। বলা ভাল, হেঁশেলে হাঁড়ি চড়ে তারই।
রানাঘাটে এখন তাই বিউটিই ডিউটি। উৎখাত হওয়া তেলেভাজার দোকানির গিন্নি ঋণ নিয়ে বাড়িতেই বিউটি পার্লার করেছেন। তাতে যে শুধু তাঁর হাঁড়ি চড়ছে, তা নয়। অন্তত পঁচিশ জন মহিলা এখন সেখানেই কাজ শিখছেন।
শহরের কথা আলাদা। এক সময়ে গ্রাম-মফস্সলে মেয়েদের সাজ বলতে বড় জোর ছিল চোখে কাজল, গালে ফেস পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক। কিন্তু এখন সব তল্লাটই পেশাদারিত্বের ছোঁয়া চাইছে। বিয়ের কনে তো বটেই। বিয়েবাড়িতে যেতে হবে শুনেই মেয়ে-বৌরা ফেসিয়াল, ভ্রূ প্লাক বা পেডিকিওর-ম্যানিকিওর করাতে ছোটেন। তার পর চুলে হাল ফ্যাশনের কাট, জীবনের আঁচ পাকা চুলে ফুটে বেরোলে হেনা বা মেহেন্দির ছোঁয়া দেওয়া তো আছেই।
এই সব কারিকুরি জানেন, এমন মেয়েদের সংখ্যাও তাই দ্রুত বাড়ছে। আর সেই হাওয়াতেই পাল তুলেছেন মাঝবয়সী তাপসী মণ্ডল। |
তাপসী মণ্ডলের নতুন পার্লারে চলছে প্রশিক্ষণ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য। |
এক সময়ে রানাঘাট স্টেশন চত্বরে তেলেভাজার দোকান ছিল তাপসীর স্বামীর। আন্ডারপাস তৈরির জন্য ভাঙা পড়ে দোকান। স্বামী নির্মাণকর্মীর কাজ নেন। বছর দু’য়েক হন্যে হয়ে কাজের খোঁজ করেছেন তাপসী। তাঁর কথায়, “আমার তিন ছেলে-মেয়ে। ওঁর একার আয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়। তাই বিয়ের পর থেকেই ছোটখাটো ব্যবসার চেষ্টা করছিলাম।” শেষমেশ রাজ্যের তফসিলি জাতি ও জনজাতি উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের কাছ থেকে সহজ কিস্তিতে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে মাস কয়েক আগে বাড়িতেই বিউটি পার্লার খুলে ফেলেন তিনি।
পার্লার তো হল। কাজ করবে কে? নিগমই একটি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাপসী নন, নিগমের আর্থিক অনুদানে বিভিন্ন জায়গার জনা পঁচিশেক মহিলা সেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। কাজ শেখা হলে তাঁরা হয় কোনও পার্লারে কাজ করবেন, অথবা নিগম থেকে ঋণ নিয়ে নিজেই পার্লার করবেন। তফসিলি জাতি ও জনজাতির নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা এই মহিলাদের বেশির ভাগেরই বাড়ি রানাঘাট শহর বা আশপাশের গ্রামে। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরের কুপার্স ক্যাম্প থেকেও তিন জন এসেছেন। সমাজের একেবারে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে উঠে আসছেন তাঁরা। কিন্তু চোখে-মুখে স্বনির্ভর হওয়ার জেদ স্পষ্ট।
রানাঘাট শহরের রিয়া দাসের কথায়, “অনেক দিন ধরেই কিছু একটা করার তাগিদ চেপে বসেছিল। নিগমের সাহায্যে এই প্রশিক্ষণের কথা জানতে পেরে আর দেরি না করে আবেদন করে দিই।” কাজ শেখার পর কী করবেন? রিয়া হাসেন, “এখন তো আনাচে-কানাচে বিউটি পার্লার। নিগমের থেকে ঋণ নিয়ে আমিও পার্লার খুলব।” প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কলেজ পড়ুয়া সুস্মিতা দাসও। তিনি বলেন, “আমি ছোট থেকেই সাজতে ভালবাসি। কিন্তু সামর্থ্য নেই। এ বার অন্যকে সাজাব, নিজেও সাজব।”
নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পার্থপ্রতিম মান্না জানান, তিন মাসের এই কোর্সে কোনও টাকা লাগে না। প্রশিক্ষণ শেষে সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। শুধু রানাঘাট নয়, রাজ্যের ন’টি জেলার ২০টি কেন্দ্রে বিউটিশিয়ান কোর্স করানো হচ্ছে। কাজের বাজার কেমন? কৃষ্ণনগরের একটি বিউটি পার্লারের মালিক সুপর্ণা চক্রবর্তীর মতে, “আমরা অনেক সময়েই ভাল কাজ জানা মেয়ে খুঁজে পাই না। নিগম ঠিক করে বিউটিশিয়ান কোর্স করালে এই মেয়েদের কাজ পেতে কোনও সমস্যা হবে না।”
তাপসী বলেন, “কাজ এক বার শিখে গেলে সংসারে স্বচ্ছলতা তো ফিরবেই। ঘরের বৌ-এর বাইরে আমারও একটা পরিচিতি তৈরি হবে। সেটাও কি কম কথা?” |
বিউটিশিয়ান গড়ার কল |
• বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নয় জেলায় ২০টি কেন্দ্র
• ১২০০ মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা
• তিন মাসের কোর্স
• প্রশিক্ষণ নিতে কোনও টাকা লাগবে না
• সপ্তাহে তিন দিন সাড়ে তিন ঘণ্টা করে ক্লাস
• প্রতি ব্যাচে থাকবে গড়ে ২৫ জন
• পুরো খরচ জোগাবে রাজ্যের তফসিলি জাতি ও জনজাতি উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম |
|