|
|
|
|
বন্ধ খামে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
নাজম শেঠি যেন ফেব্রুয়ারির গরমে লাহৌরে বসে সান্তাক্লজের ক্রিসমাস ইভের উপহার পেয়ে গেলেন! সোমবার পাক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত পাকিস্তান বোর্ডের নয়া শীর্ষকর্তা হয়েছেন শেঠি। আইসিসিতে ভারতকে সামলাতে না পারার অপরাধে এ দিনই নওয়াজ শরিফ ‘বলি’ দিয়েছেন আগের পাক বোর্ড প্রেসিডেন্ট জাকা আশরাফকে। শেঠি এসেই ভারতের দিকে ছুড়ে মারার ক্রিকেট-পরমাণু অস্ত্র পেয়ে গেলেন! সোমবার রাতে করাচি ক্রিকেটমহলের জল্পনা হল, এ বার শেঠি আর এহসান মানি মিলে সোজা যান ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার কাছে। গিয়ে বলুন, কার সঙ্গে গাঁটছড়া পাতিয়েছেন এ বার বুঝেছেন? ভারতের আদালতের খবর দেখছেন? গত ক’দিন আইসিসি বিপর্যয়ে বিমর্ষ থাকা পাকিস্তান ক্রিকেট সান্তার অকস্মাৎ উপহারে হঠাৎ যেন চেগে উঠেছে।
আসলে আইসিসি-র এথিকস কোডে আছে শীর্ষপদে আসীন কারও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যদি খেলাকেন্দ্রিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন, তা হলে তাঁর সেই পদে বসা চলবে না। সোমবার বিচারপতি মুকুল মুদগল এবং অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল নাগেশ্বর রাও-এর পরিচালিত তথ্যানুসন্ধান কমিটি যে রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছে, তার আত্মিক অনুসরণ করা হলে জুনে আইসিসি-র চেয়ারম্যান পদে বসা অবশ্যই আটকে যাওয়া উচিত নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের।
সিএসকে এবং শ্রীনিবাসনের জামাইয়ের বিরুদ্ধে তথ্যানুসন্ধান কমিটি যে ভাবে রিপোর্ট দিয়েছে, সেই কঠোর পর্যবেক্ষণ ভারতীয় ক্রিকেটে একমাত্র আজহারদের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের দেওয়া রিপোর্টের সঙ্গে তুলনীয়। বোর্ড নিযুক্ত তামিলনাড়ুর দুই প্রাক্তন বিচারপতির কমিশন গুরুনাথ মইয়াপ্পনকে ঠিক যতটা ছাড় দিয়েছিল, ঠিক ততটাই কঠিন ভাবে আছড়ে ফেলেছে নতুন রিপোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট তা বিবেচনা করবে আগামী ৭ মার্চ। |
|
আরও চাঞ্চল্যকর হল, রিপোর্টের সঙ্গে সিল করা একটা খাম কমিটি জমা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার বিচারপতি পট্টনায়কের জন্য। এ দিন পেশ করা রিপোর্ট যেমন খোলা, যে কেউ দেখতে পারেন। কিন্তু এই খাম বিচারপতি ছাড়া কেউ খুলতে পারবেন না। শোনা যাচ্ছে, খামের মধ্যে সন্দেহভাজন কিছু নামের কথা কমিটি উল্লেখ করেছে। বলেছে, আমাদের কোনও সলিড তথ্য নেই, কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, মহাতারকা কিছু ক্রিকেটারের নাম রয়েছে সন্দেহভাজনের তালিকায়। হ্যাঁ বা নামুদগল কিছুই বলছেন না।
সোমবার দুপুরে মুদগল রিপোর্ট আছড়ে পড়ে আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে দেওয়ার পরেও বিসিসিআই অবশ্য নির্বিকার। রাজীব শুক্ল হালকা বিবৃতিতে বলেছেন, “এটা তো নিছকই সুপারিশ। রায় নয়। আদালতের রায়ের জন্য আমরা মার্চ মাস অবধি অপেক্ষা করব। এখন আইপিএল নিলাম যেমন বুধবার ও বৃহস্পতিবার বেঙ্গালুরুতে হবে, তেমনই হবে।”
বোর্ড কর্তারা এতই নির্বিকার যে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের জরুরি সভা অবধি ডাকছেন না। নিলামের পর দ্বিতীয় দিন বেঙ্গালুরুতে একটা সভা ডাকা হয়েছে। সেটাও সদস্যদের জানানো হয় গত কাল। তার কোনও আলোচ্যসূচি জানানো হয়নি। সোমবার নতুন করে কোনও বার্তাও আসেনি।
অথচ তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট এতই মারাত্মক যে, তা মেনে চললে অবিলম্বে
(ক) চেন্নাই সুপার কিংসকে সাসপেন্ড করতে হয়।
(খ) মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে শো-কজ এবং প্রয়োজনে কড়া শাস্তি দিতে হয়।
(গ) আইপিএল মহাকর্তা সুন্দর রামনকে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করার জন্য কাউন্সিলের সভায় ডাকতে হয়।
(ঘ) সর্বাগ্রে শ্রীনিবাসনকে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে বোর্ড এবং সিএসকে ছাড়তে হয়। কমিটি তাঁর বিরুদ্ধেও বকলমে অসত্য সাক্ষ্যদানের অভিযোগ এনেছে। আর অন্য প্রসঙ্গে বলেছে, বোর্ড এবং সিএসকে দু’টোই এক সঙ্গে চালাতে গিয়ে স্বার্থের সংঘাত তাঁর ক্ষেত্রে সত্যি ঘটছে কি না, সেটা যদিও এই কমিটির আওতায় পড়ে না, কিন্তু বিষয়টা এতই গুরুতর যে তা নিয়ে সর্বাঙ্গীন তদন্ত হওয়া উচিত।
শ্রীনিবাসন শিবিরের যথেষ্ট আন্দাজ ছিল যে মুদগল কমিটির রিপোর্ট তাদের বিরুদ্ধে যেতে পারে। এমন দ্রুততার সঙ্গে আট দেশের ভোট জোগাড় করে শ্রীনি যে শনিবার আইসিসি চেয়ারম্যান হওয়া নিশ্চিত করে ফেলেন, তার কারণ এটাই ছিল যে, ১০ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণে না-ও থাকতে পারে, তা তিনি অনুমান করেছিলেন। কিন্তু রিপোর্ট যে এত কড়া ভাবে আছড়ে পড়বে, শ্রীনিও ভাবেননি।
সোমবার বিচারপতি মুদগলকে নয়াদিল্লিতে ফোনে যোগাযোগ করে আনন্দবাজারের তরফে তিনটে প্রশ্ন করা হয়।
• শ্রীনিবাসনের কি পদত্যাগ করা উচিত নয়?
“এ ব্যাপারে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। যা বলার ছিল, রিপোর্টে বলে দিয়েছি।”
• মইয়াপ্পন যে বেটিংয়ে জড়িত ছিলেন, আপনারা নিশ্চিত?
“সম্পূর্ণ নিশ্চিত। টিমের গোপন খবর আদানপ্রদানেও জড়িত ছিল। তবে ফিক্সিং করেছে কি না, নিশ্চিত বলতে পারব না।”
• তাই যদি হয়, মহাতারকা কিছু ক্রিকেটারও তো জড়িত?
“এ ভাবে বলা ঠিক হবে না। আমার রিপোর্টটা মন দিয়ে পড়ুন।” |
মুদগল রিপোর্টে |
• গুরুনাথ মইয়াপ্পনের বিরুদ্ধে বেটিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ সত্যি। তিনি সিএসকে-র টিম অফিসিয়ালও।
• মইয়াপ্পন শুধু সিএসকে-র পক্ষেই বেটিং করেননি, বিপক্ষেও বেটিং করেছেন।
• ১২ মে, ২০১৩-র রাজস্থান বনাম চেন্নাই ম্যাচ নিয়ে আরও তদন্ত প্রয়োজন।
• ক্রিকেট জুয়ার আড়ালে দাউদ ইব্রাহিম এবং ছোটা শাকিল। দু’জনের মদতেই চলে বেটিং সিন্ডিকেট।
• রাজ কুন্দ্রার বিরুদ্ধে আনা বেটিং এবং গড়াপেটার অভিযোগ নিয়ে আরও তদন্ত হওয়া দরকার। |
|
রিপোর্টে বিচারপতিরা সুপারিশ করেছেন গভর্নিং কাউন্সিলের সঙ্গে একটা ইন্টিগ্রিটি কমিটি জুড়তে। তাতে সদস্য কারা থাকবেন, সেটাও তাঁরা বলে দিয়েছেন। তেন্ডুলকর, সৌরভ, কুম্বলে, দ্রাবিড় ও লক্ষ্মণ। বলেছেন, এই ক’জনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। ও সব বিদেশি গোয়েন্দা দিয়ে ক্লাস-টাস না করিয়ে এঁদের কথা বলতে দেওয়া হোক তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে। এঁরা সততার কথা বললে ক্রিকেটাররা অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ হবেন। তাঁরা বলেছেন, অবিলম্বে আইপিএল পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। বলেছেন, রাজ কুন্দ্রা ও শিল্পা শেট্টি বেটিং করেছেন কি না, সে ব্যাপারে আরও তদন্তের অবকাশ রয়েছে।
রিপোর্টের আসল অংশ অবশ্যই মইয়াপ্পন। বিচারপতিদের কাছে ধোনি এবং শ্রীনিবাসন দু’জনেই বলেছিলেন, মইয়াপ্পন নিছকই ক্রিকেট-উৎসাহী। সিএসকে-র কর্তা নন। তদন্তে দেখা গিয়েছে, দু’জনের সাক্ষ্যই মিথ্যে। মইয়াপ্পন প্র্যাকটিসে থাকতেন। ওনার্স ডাগআউটে বসতেন। নিলামের টেবলে থাকতেন। টুইটারের হ্যান্ডলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন টিম প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে। বিতর্ক বাধার পর সেই অ্যাকাউন্ট উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। মুম্বই পুলিশ বলেছে, তাঁর লেটারহেড এবং বিজনেস কার্ডে পরিচয় থাকত টিম ডিরেক্টর হিসেবেই। আইপিএল প্রধান সুন্দর রামন বোঝাতে চেয়েছেন চেন্নাইয়ের টিম মালিক কে, সেটা নাকি ঠিক বোঝা যায়নি। ব্যাপারটা অস্বচ্ছ ছিল। অথচ দেখা যায় গোল্ড পাস, ব্লু পাস সমস্ত আইপিএল থেকে মইয়াপ্পনের জন্য তোলা হয়েছিল। টিমের ব্যাপারে সমস্ত রকম খবর তাঁর কাছে থাকত। অর্থাৎ শ্রীনিবাসন-ঘনিষ্ঠ সুন্দরও ঠিক সাক্ষ্য দেননি।
গত বছর ১২-মে-র রাজস্থান রয়্যালস ম্যাচ ঘিরে বিচারপতিরা যথেষ্ট অনুসন্ধান চালিয়েছেন। দেখেছেন, সেই ম্যাচের ১২ ওভারে মইয়াপ্পন ফোনে বলেন, সিএসকে-র মোট রান ১৩০ থেকে ১৪০-এর মধ্যে থাকবে। এর ওপর তিনি বাজি খেলবেন। যেটা বিস্ময়কর ছিল। কারণ সিএসকে তখন ১২তম ওভারে ১ উইকেটে ৮৬। এর পরেই অত্যাশ্চর্য ভাবে রান রেট পড়তে থাকে। ধোনি, রায়না আর জাডেজা, তিন টি-টোয়েন্টি স্পেশ্যালিস্ট মোট ১৯ বলে করেন ১৫ রান! তত দিনে টুর্নামেন্টের মূলপর্বে চলে যাওয়া রিল্যাক্সড সিএসকে এতগুলো ছক্কা-হিটার নিয়েও গোটা ইনিংসে একটাও ছক্কা মারতে পারেনি! যেখানে রাজস্থান রয়্যালস মেরেছিল সাতটা। কুম্বলে বলেছেন, জয়পুরে শেষের দিকে বল সুইং করে বেশি। তখন রান তোলা কঠিন হয়। দ্রাবিড় বলেছেন, সে দিন ধোনি বা রায়নার আউট হওয়ার ধরন তাঁর মোটেও সন্দেহজনক লাগেনি। বিচারপতিদের যদিও মনে হয়েছে, আশ্চর্যজনক ভাবে সিএসকে-র বিরুদ্ধে বাজি ধরেও সেটা প্রায় অব্যর্থ মিলিয়ে দিয়েছেন মইয়াপ্পন। তিনি পয়সা ঢেলেছিলেন ১৩০ থেকে ১৪০-এর মধ্যে রান হবে বলে। ইনিংসের শেষ বলে ডোয়েন ব্র্যাভোর খোঁচাটা অতর্কিত চার হয়ে যাওয়ায় রান দাঁড়ায় ১৪১-৪। ওই বাউন্ডারিটা না হলে মইয়াপ্পন পুরো টাকাটাই জিততেন। বিচারপতিরা এই ম্যাচ নিয়ে বিস্তারিত তদন্তের সুপারিশ করেছেন। তীব্র জল্পনা শুরু হয়েছে তাঁদের সিল করা খামের ভিতর এই ম্যাচ নিয়ে ঠিক কী পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে? আর সেটা জানাজানি হলে ভারতীয় ক্রিকেটে আরও বড় কোনও বিস্ফোরণ হবে কি না? |
ধোনি বলেছে, টিমে মইয়াপ্পনের ভূমিকা ঠিক কী, সেটা ও জানে না। ন্যাকামি? গোটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ায় ধোনিও সমান জড়িত।
ললিত মোদী |
আইসিসি-র এথিকস অফিসারের খুব খুঁটিয়ে এই রিপোর্ট পড়া উচিত। দেখা উচিত শ্রীনির আচরণ উপযুক্ত পর্যায়ে রয়েছে কি না। আইসিসি প্রধান যিনি হবেন তাঁকে অবশ্যই সব সন্দেহের উর্ধ্বে হতে হবে।
এহসান মানি |
|
একটা ব্যাপার নিয়ে অবশ্য কোনও তর্ক নেই। শ্রীনির বোর্ড যতই ‘ধীরে চলো’ নীতি নিক না কেন, এ বারের বিতর্কের হিমশৈল শুধু আইপিএল এবং ভারতবর্ষেই থামবে না। তাড়া করবে সাগরপারে জুনের আইসিসি পর্যন্ত। গত এক মাস ধরে আইসিসি-র ক্ষমতা দখলের ‘রক্তক্ষয়ী’ লড়াইয়ে শ্রীনিবাসনের বিরোধীপক্ষকে সংগঠিত রেখেছেন প্রাক্তন আইসিসি প্রধান এহসান মানি। সোমবার রাতে রাওয়ালপিন্ডি থেকে আনন্দবাজারকে ফোনে মানি বললেন, “আমার তো মনে হয় আইসিসি-র এথিকস অফিসারের খুব খুঁটিয়ে এই রিপোর্ট পড়া উচিত। দেখা উচিত, শ্রীনি-র আচরণ উপযুক্ত পর্যায়ে রয়েছে কি না। আইসিসি প্রধান যিনি হবেন, তাঁকে অবশ্যই সব রকম সন্দেহের ঊর্ধ্বে হতে হবে।” মানি উদাহরণ দিলেন, তিনি আইসিসি প্রধান থাকাকালীন আবিষ্কৃত হয়েছিল এক ডিরেক্টরের মা বুকমেকিং ফার্মের সঙ্গে যুক্ত। যারা ক্রিকেট নিয়ে বেটিং করে থাকে। অভিযোগ ওঠা মাত্র শ্রীলঙ্কার সেই ডিরেক্টরকে আইসিসি থেকে ইস্তফা দিয়ে সরে যেতে হয়েছিল। তাঁর কথায় প্রছন্ন ইঙ্গিত, জুনে সিংহাসনে বসার আগে শ্রীনি-কে ফের নতুন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করাতে চাইবেন বিরোধীরা।
এ বার দেখার নাজম শেঠিরা সান্তার উপহার কাজে লাগাতে পারেন কি না? নাকি ক্রিকেট বিশ্বব্যাপী তাঁকে ঘিরে কেলেঙ্কারির ধোঁয়ার মধ্যেও শ্রীনি থেকে যান সেই একই রকম অবিচলিত? |
পুরনো খবর
• আইসিসি-র শীর্ষে শ্রীনি, বোর্ডের সিংহাসনও থাকবে কি না জল্পনা
• শ্রীনি-ধোনি জুটিটা ভাঙতে হবে |
|
|
|
|
|