নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন সেই ক্রিকেট বিশ্বের মগডালে উঠেই পড়লেন। উপমহাদেশের তীব্র বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে নাটকীয় ভাবে শেষ মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকাকে দলে টেনে শ্রীনি হয়ে গেলেন আইসিসি-র ইতিহাসে প্রথম চেয়ারম্যান। জুন মাসে যিনি অভিষিক্ত হবেন।
কিন্তু অনেকের মতে, মগডালে উঠতে গিয়ে যে ডালে তিনি আপাতত আসীন, সেটাই আধখানা কেটে ফেলেছেন বোর্ড প্রধান! ভারতীয় ক্রিকেট মহলে কেউ কেউ বললেন, “আরআইপি ক্রিকেট। ক্রিকেট, তুমি সমাহিত হও।” টুইটারে সেটা লিখলেনও। আর কেউ কেউ বললেন, কালিদাসের পর শ্রীনিবাসন!
ভারতীয় ক্রিকেটমহল জুড়ে শনিবার তীব্র জল্পনা চলল, বোর্ডে শ্রীনি-রাজের অবসান ঘটল কি না, তা নিয়ে। আইসিসি-র সদস্য দেশগুলোর ধারণা ঘটল। কারণ আইসিসি-র সর্বোচ্চ পদে থাকার পর শ্রীনি আর নিজের বোর্ডে থাকতে পারেন না। তা হলে নিরপেক্ষতা বলে কিছু থাকে না। শেষ মুহূর্তে শ্রীনির সঙ্গে হাত মেলানো দক্ষিণ আফ্রিকা বোর্ডেরও একই মত। আইসিসি-কে পাঠানো গোপন ই-মেলে (যা একমাত্র আনন্দবাজারের হাতে এসেছে) দক্ষিণ আফ্রিকা বোর্ড সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, নতুন চেয়ারম্যানকে তারা কোনও দেশের সঙ্গে সংযুক্ত দেখতে চায় না। রাতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, তাঁরও ধোঁয়াশা রয়েছে যে, শ্রীনি কি দু’টো পদেই থাকলেন? মুম্বই থেকে বোর্ড কর্তা রত্নাকর শেট্টি বললেন, “পরিষ্কার কিছু বুঝতে পারছি না। মনে হয় শ্রীনি দু’টো পদেই থাকবেন।” করাচি থেকে পাক বোর্ডের সদস্য বললেন, “হরগিজ না। শুধু আইসিসি-তে থাকবেন।” রাতে আবার সিঙ্গাপুর থেকে শ্রীনিবাসন জানালেন, “আমি দু’টো পদেই আছি। কারণ এ নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই।” |
সিঙ্গাপুরে আইসিসি বৈঠকের পর শ্রীনিবাসন। ছবি: এএফপি। |
আইসিসি-র ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি, এ দিন সিঙ্গাপুরে সেটা ঘটল। নির্দিষ্ট কোনও ইস্যু ঘিরে দশটা দেশের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠল না। একটা সময় পাকিস্তান ঠিক করেছিল, বৈঠক থেকে তারা ওয়াকআউটই করবে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা স্থির করে, তারা ওয়াকআউট করবে না। কিন্তু ভোটও দেবে না। দু’দেশই আইসিসি-র বিরুদ্ধে আইনি রাস্তা খোলা রাখল। যদিও শ্রীনি-পক্ষের কেউ কেউ মনে করিয়ে দিলেন, আদালতে গেলে ওরা হারবে। কারণ আইসিসি-র সংবিধান অনুযায়ী দশ দেশের মধ্যে আট দেশের সম্মতি নিয়েই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
পরিস্থিতি নাটকীয় ভাবে ঘুরে যায় শুক্রবার মাঝরাতে, শ্রীনিবাসনের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ক্রিস নেজনানির বৈঠকের পর। শ্রীনি এই সময় তাঁকে ব্যক্তিগত আশ্বাস দেন, আইসিসি-র এগজিকিউটিভ কমিটিতে তিন প্রধান ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকা থাকবে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ভারত নিয়মিত টেস্ট, ওয়ান ডে সিরিজ খেলবে। আর দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়মিত ভাবে বিশ্ব পর্যায়ের টুর্নামেন্ট দেওয়া হবে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বলা হয় ক্রিকেটে চার প্রধান থাকল। আপনারা। আমরা। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া।
এই আশ্বাস পাওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার মুখ্য কর্তা পাক-শ্রীলঙ্কাকে জানিয়ে দেন, তাঁরা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ভোট না দিলে প্রস্তাব পাশ করানো যেত না। কারণ ম্যাজিক ফিগার ছিল দশে আট। দক্ষিণ আফ্রিকা এ কথা বলছে শুনে হতবাক হয়ে যান উপমহাদেশীয় কর্তারা। পাক বোর্ড প্রেসিডেন্ট জাকা আশরাফ বলতে থাকেন, “এটা করলে আপনারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করবেন। ভুল করছেন ভারতীয় বোর্ডের ভাঁওতায় ভুলে। ওরা আমাদেরও নানান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কখনও গ্যারান্টি দেয়নি। আপনারা বুঝছেন না প্রতিশ্রুতি আর গ্যারান্টির মধ্যে একটা ফাঁক আছে।” |
রাতে করাচিতে ফোন করে জানা গেল, আইসিসি-র এ দিনের ঘটনাবলি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে পাকিস্তানে। প্রবাদপ্রতিম প্রাক্তন ক্রিকেটারদের কেউ কেউ বলেছেন, আমাদের বোর্ড কর্তাদের উচিত ছিল নওয়াজ শরিফকে দিয়ে মনমোহন সিংহের সঙ্গে কথা বলা। ভারতীয় বোর্ডের এই নোংরামি তা হলে বন্ধ করা যেত। এমনকী ওয়াসিম আক্রম যিনি ভারতে ধারাভাষ্য দেন ও ভারতীয় বোর্ডের দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল, তিনিও বলেছেন, “জিনিসটা মোটেও ভাল হল না। বিশ্ব ক্রিকেটে আরও ভারসাম্য আসা উচিত।” শ্রীলঙ্কা বোর্ড প্রেসিডেন্ট ধর্মদাসা অবশ্য বেশি উত্তেজিত দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে। সিঙ্গাপুরে এ দিন তিনি বলেছেন, “ওরা আমাদের পিছন থেকে ছুরি মারল। দেখি আমরা আইসিসি-র বিরুদ্ধে আদালতে যাই কি না।” কেউ কেউ এখনও আশায় রয়েছেন, আইপিএল গড়াপেটার তদন্তের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত মুদগল কমিটির রিপোর্ট যদি চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে যায়। সে ক্ষেত্রে বিশ্ব ক্রিকেটমঞ্চে শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
শ্রীনি-সমর্থকরা অবশ্য আনন্দে আত্মহারা। তাঁরা মনে করেন, ভারত এই প্রথম সরকারি ভাবে ক্রিকেটের প্রথম বিশ্ব হয়ে গেল। আইসিসি সরকারি ভাবে পাশ করে দিল যে, ক্রিকেট খেলাটা চালাবে ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া। সঙ্গে থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর শ্রীনিবাসন হয়ে গেলেন দণ্ডমুণ্ডের ঘোষিত কর্তা। এত দিন ছিলেন ভারতের। এখন হয়ে গেলেন গোটা বিশ্বের।
তবু উপমহাদেশীয় ক্রিকেটমহলে অনেকেরই ধারণা, জুন মাসে শ্রীনি কাঁটার মুকুট পরবেন, ক্রিকেট-সম্রাটের নয়। তাঁরা মনে করেন, ওপর ওপর মনে হচ্ছে, ভারত ক্রিকেটের ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে ঢুকে গেল। ভেতরের আসল ছবিটা হল ক্রিকেট একদা শ্বেতাঙ্গদের খেলা ছিল, আবার শ্বেতাঙ্গ সমাজেই ফেরত গেল। ১৮৭৭-এ প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া। তারাই ছিল খেলাটার যোগ্য ধারক ও বাহক। শ্রীনিবাসনের ভ্রমাত্মক মডেলে তারাই আবার হৃত সাম্রাজ্য ফেরত পেল। ভারত ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘিষ্ঠ ছিল ১-২। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভোটে টানতে গিয়ে সেটা দাঁড়াল ১-৩।
অর্থাৎ, ‘আরআইপি উপমহাদেশীয় ক্রিকেট’। সচিনের যেমন অবসর ঘটে গিয়েছে এটাই সত্যি। উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের রমরমাও তেমনই সমাহিত! |