|
|
|
|
ম্যান্ডেলাকে উদ্ধৃত করে আইসিসি-নীতিকে অগণতান্ত্রিক বলল দক্ষিণ আফ্রিকা |
সিঙ্গাপুর ক্রিকেট মহাবৈঠক আজ অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
চব্বিশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় ক্রিকেটের গৌরবগাথা উৎপাদনের জন্য যদি সচিন তেন্ডুলকর থেকে থাকেন। তিনি— নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন যেন আধুনিক সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন উপর্যুপরি বিতর্ক, কেলেঙ্কারি আর ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে নেতিমূলক মনোভাব উৎপাদনের জন্য।
সিঙ্গাপুরে শনিবার আইসিসি-র মহাগুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আগে আবার বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে সেই শ্রীনিবাসন। এবং তাঁর আনা সেই ‘কালা প্রস্তাব’, যা ক্রিকেট বিশ্বকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়ার উপক্রম করেছে। বৈঠকের চব্বিশ ঘণ্টা আগে যা পরিস্থিতি, তাতে ভারত যদি ফলো-অন বাঁচিয়ে অকল্যান্ড টেস্ট ম্যাচ জিতে যায়, সে রকমই অলৌকিক হবে সিঙ্গাপুরে শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে। ক্রিকেট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফোনে কথা বলে এ দিন জানা গেল, খাতায়-কলমে তিন প্রধান একসঙ্গে থাকলেও। তারা যথাক্রমে ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া হলেও বিরোধীদের বিদ্বেষের তির সবচেয়ে বেশি শ্রীনিবাসনের দিকে। সমীকরণটা ঠিক এই জায়গায় যে, দশ দেশের মধ্যে ভারত-সহ সাত দেশ এক দিকে। বাকি তিন দেশ আরেক দিকে। এই তিন দেশ যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা।
সুতরাং এশীয় ঐক্য ভাঙার যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল, সেটা আপাতত চুরচুর হয়ে বধ্যভূমিতে গড়াচ্ছে। এশীয় মডেল তৈরি করে এক কালে যিনি সাহেবদের জব্দ করেছিলেন, সেই জগমোহন ডালমিয়া শুক্রবার স্বগতোক্তি করছিলেন, “ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বাস করে শ্রীনি বিশাল ভুল করছে। বছরখানেক বাদে ওরা ইন্ডিয়ার বিপক্ষে চলে যাবেই। তখন আমরা ভোটে হেরে যাব।” |
|
|
সচিন-শ্রীনি। যেন মুদ্রার দুই পিঠ। |
|
শ্রীনিবাসনরা মনে করেন, ম্যাজিক ফিগার হল সাত। দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ-সহ সাত দেশ যেখানে তাঁদের দিকে, সেখানে তাঁরা যে কোনও প্রস্তাব সভায় গৃহীত করিয়ে নিতে পারেন। বিরোধীদের তীব্র পাল্টা বক্তব্য, ম্যাজিক ফিগার হল আট। দশ দেশের মধ্যে আট দেশের সম্মতি হলে তবেই সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব। আর এ ক্ষেত্রে যেহেতু তিন দেশ সম্পূর্ণ এককাট্টা, সেখানে ভাঙন ধরানো যাবে না।
শ্রীলঙ্কা বোর্ডকে শ্রীনিবাসন টোপ দিয়েছিলেন, আইসিসি-র হেডকোয়ার্টার তোমাদের দেশে দিয়ে দেব। শ্রীলঙ্কা সেই টোপ শুধু সযত্ন প্রত্যাখ্যানই করেনি, আইসিসি-কে চার পাতার দীর্ঘ চিঠি পাঠিয়েছেন তাদের প্রেসিডেন্ট জয়ন্ত ধর্মদাসা। সঙ্গকারার শটগুলো যেমন গত ক’দিন বাংলাদেশ বোলারদের বিরুদ্ধে আছড়ে পড়েছে, তেমনই তীব্র ধর্মদাসার চিঠির বয়ান। তিনি লিখেছেন, ‘অর্থ বাঁটোয়ারার যে পদ্ধতি আপনারা প্রয়োগ করতে চাইছেন, সেটা অত্যন্ত অন্যায় এবং আমাদের মতো দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও কোনও স্বচ্ছতা নেই। অর্থ বিতরণের এই পদ্ধতি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ আপত্তিজনক এবং অনৈতিক।’ আইসিসি-র আইনি শাখার প্রধান আয়ান হিগিন্স এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে এ দিন বলেছেন, “যা করা হয়েছে, সবই সংবিধান মেনে।” যা একেবারেই মানতে রাজি নয় শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা বোর্ডের কোনও কোনও সদস্য বলেছেন, সিঙ্গাপুরের বৈঠকে তেমন ত্যান্ডাইম্যান্ডাই দেখলে আমাদের উচিত ওয়াকআউট করা। তিন দেশ
ঠিক করেছে, তেমন হলে তারা বসে পাল্টা ‘পজিশন পেপার’ তৈরি করবে। করে সেটা ছুড়বে আইসিসি-র দিকে। শ্রীলঙ্কা বোর্ড যেমন প্রশ্ন তুলেছে, এফটিপি যদি বানচাল করে দেওয়া হয়, ইতিমধ্যে যে সব স্পনসরদের সঙ্গে সফরের জন্য আমাদের চুক্তি হয়ে গিয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দেবে কে? আইসিসি কি দেবে?
প্রচণ্ড উত্তেজিত আর ক্ষুব্ধ দক্ষিণ আফ্রিকাও। তারা ন’পাতার ই-মেল পাঠিয়েছে আইসিসি-কে। মেলের প্রথম চারটে পরিচ্ছদ নেলসন ম্যান্ডেলাকে উদ্ধৃত করা। তাতে বলা হয়েছে, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা সারা জীবন লড়াই করেছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এবং অগণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। আইসিসি-তে তিন প্রধান সাজতে গিয়ে ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া যা করছে, তা গণতন্ত্রকে পায়ের তলায় পিষে ফেলা। আর ম্যান্ডেলা-নীতির তীব্র বিরোধী। এটা আমরা কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না।’ শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা আর পাকিস্তান কর্তারা শুক্রবার রাতে একপ্রস্ত মহড়াতেও বসলেন। বৈঠকে তাঁদের স্ট্র্যাটেজি কী হবে, তা চূড়ান্ত করে নেওয়ার জন্য। বলা যেতে পারে ড্রেস রিহার্সাল। উপমহাদেশীয় জোট ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও অপ্রত্যাশিত এই নতুন ত্রিমুখী জোট গড়ে উঠেছে। যাঁরা মনে করেন, শনিবার শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
ভারতীয় বোর্ড কর্তারা কি এই নিয়ে বিচলিত? শুক্রবার রাতে তাঁদের কেউ কেউ বললেন, “সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। বাংলাদেশও তো কত কিছু বলেছিল। তার পর তো সুড়সুড় করে রাজি হয়ে গেল।”
ত্রিমুখী জোট অবশ্য তাদের কেউ বশ্যতা স্বীকার করাতে পারে, এমন ধারণাকে আমলই দিচ্ছে না। বরঞ্চ উল্টে বলছে, এ সব মহাজোট যারা করতে চাইছে তারা আগে নিজের ঘর সামলাক। কেভিন পিটারসেনকে বাদ দেওয়া নিয়ে ইংল্যান্ড শীর্ষ কর্তা জাইলস ক্লার্ক এখন তীব্র বিক্ষোভের মুখে। এমন অবস্থা যে, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পর্যন্ত পিটারসেনকে ছেঁটে ফেলায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এক এশীয় ক্রিকেট কর্তা বললেন, “আগে ওরা ডেভিড ক্যামেরনকে সামলাক। তার পর না হয় আমাদের সামলাবে।” তাঁদের ধারণা, শ্রীনিবাসনেরও শিরে সংক্রান্তি। সোমবার মুদ্গল কমিটির রিপোর্ট বেরোচ্ছে। তীব্র কানাঘুষো শুরু হয়ে গিয়েছে, সেই রিপোর্ট চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে যেতে পারে। বিরোধীদের স্ট্র্যাটেজি হল, সিঙ্গাপুর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হতে দিও না। ব্যাপারটাকে আরও ঝুলিয়ে দাও। যাতে সেই সময় বিপক্ষকে আরও দুর্বল, চাপে জর্জরিত অবস্থায় পাওয়া যায়।
আর শ্রীনিবাসন ঠিক ততখানিই মরিয়া। সোমবার মুদ্গল কমিটির রিপোর্ট বেরনোর আগেই তিনি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় হেস্তনেস্ত চান। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি লর্ড উলফ এ দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আইসিসির নতুন বিচার পদ্ধতি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। আর ক্রিকেটকে পিছিয়ে দেওয়ার একটা পদ্ধতি।” বিরোধীরা উৎসাহিত হয়ে বলছেন, এ বার খোদ ইংল্যান্ডেই বিরোধী আওয়াজ উঠতে শুরু করল। শ্রীনি ঘনিষ্ঠ শিবিরে বলেছেন, কাঁটা শনিবারেই উপড়ে ফেলতে হবে। দেরি করা যাবে না। আর যত তিনি চরমপন্থী হচ্ছেন, ততই বিশ্ব ক্রিকেট দুনিয়ায় বাড়ছে তাঁর প্রতি অসন্তোষ।
লর্ডসে তেন্ডুলকর ফের ওয়ার্নের বিরুদ্ধে খেলবেন শুনে যেমন সর্বত্র খুশির হাওয়া। তিনি— শ্রীনিবাসন এই মুহর্তে ঠিক ততটাই অশান্তির হাওয়া। একই মুদ্রার যেন এ পিঠ আর ও পিঠ। সাদা আর কালো। সচিন আর শ্রীনি। |
পুরনো খবর: আইনি জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শ্রীলঙ্কার চিঠি আইসিসি-কে |
|
|
|
|
|