শিক্ষক নেই, ধুঁকছে তেলুগু-ওড়িয়া স্কুল
ঝাঁ-চকচকে স্কুল ভবন। রয়েছে পঠনপাঠনের উপযুক্ত পরিবেশও। তবু খড়্গপুরের তেলুগু ও ওড়িয়া স্কুলগুলিতে পড়ুয়া সংখ্যা ক্রমশ কমছে। কারণ, তেলুগু বা ওড়িয়া জানা শিক্ষকের অভাব। রাজ্য শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, অন্য রাজ্যের জাতিগত শংসাপত্র এ রাজ্যে সরকারি চাকরির ক্ষত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। সে জন্যই এই স্কুলগুলিতে শিক্ষকের পদ শূন্য থাকলেও নিয়োগ হচ্ছে না।
বিষয়টি অজানা নয় স্কুল শিক্ষা দফতরেরও। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক সঙ্ঘমিত্র মাকুড় বলেন, “ওই সব স্কুলে শিক্ষকের অভাবের বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সার্ভিস কমিশনের বিজ্ঞাপন ভিন্ রাজ্যেও হয়। তবে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অন্য রাজ্যের জাতিগত শংসাপত্র এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। নিয়ম ভেঙে কিছু করার উপায়ও নেই।” সঙ্ঘমিত্রবাবু আরও বলেন, “স্কুলের উন্নয়নে সর্বশিক্ষা মিশন টাকা দেয়। তবে পড়ুয়া সংখ্যা কমতে থাকায় সেই অর্থের পরিমাণও কমছে। অনেকেই বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চলে যাচ্ছে। আমরা সার্ভিস কমিশনে সমস্যার কথা জানাচ্ছি। আপাতত স্কুলগুলি অনধিক ৩ জন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়ে কাজ চালাতে পারে। এর বাইরে এখন আর কোনও রাস্তা নেই।”
(বাঁ দিকে) শিক্ষকের বহু পদ শূন্য খড়্গপুরের অন্ধ্র হাইস্কুলে।
(ডান দিকে) কোনও রকমে ক্লাস চলছে উৎকল বিদ্যাপীঠে। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
‘মিনি ইন্ডিয়া’ খড়্গপুরে নানা ভাষাভাষি মানুষের বাস। তেলুগু, ওড়িয়া ছাড়াও রয়েছেন তামিল, গুজরাতি। রেলে চাকরির সূত্রেই এঁদের খড়্গপুরে আসা এবং থেকে যাওয়া। এ রাজ্যের সব থেকে বেশি তেলুগুভাষি মানুষ থাকেন খড়্গপুরে। এ জন্য রেলশহরকে অনেকেই ‘ছোট্ট অন্ধ্র’ নামে ডাকেন। খড়্গপুরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৭ শতাংশ তেলুগু আর ১২ শতাংশ ওড়িয়াভাষী মানুষ। নিমপুরা, মথুরাকাটি, ওল্ড সেটেলমেন্ট, পোর্টারখুলি, চায়না-টাউন, আইমা এলাকায় এঁদের বাস। অন্য প্রদেশের মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই ওখানে গড়ে উঠেছে তেলুগু, ওড়িয়া ও হিন্দি মাধ্যমের স্কুল। এই স্কুলগুলি রাজ্য শিক্ষা দফতর অনুমোদিত। দফতরের আইন মেনেই স্কুল চলে। যেহেতু অন্য রাজ্যের জাতিগত শংসাপত্র সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এ রাজ্যে মান্যতা পায় না, সে জন্য ওড়িশা বা অন্ধ্রপ্রদেশে বেড়ে ওঠা কেউ ইচ্ছে এবং যোগ্যতা থাকলেও খড়্গপুরের ওড়িয়া বা তেলুগু স্কুলে চাকরি করতে পারবেন না। ফলে, যোগ্য শিক্ষকের অভাবে ঝুঁকছে এই স্কুলগুলি।
খড়্গপুরের নিউ সেটেলমেন্ট এলাকার ‘অন্ধ্র হাইস্কুলে’র কথাই ধরা যাক। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল ইংরেজি মাধ্যম হলেও এখানে প্রথম ভাষা হিসেবে পড়ানো হয় তেলুগু। বেশিরভাগ তেলুগুভাষী পড়ুয়াই এখানে পড়ে। ফলে, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল পড়ানোর সময় অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক তেলগুতে বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। কিন্তু তেলুগু জানা শিক্ষকের অভাবে সেই সুযোগ মিলছে না। উচ্চ মাধ্যমিক এই স্কুলে ২০১২ সাল থেকে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। সহ-শিক্ষকের পদ ৩৭টি। কিন্তু শিক্ষক রয়েছেন সাকুল্যে ২৩ জন। ৬টি তফসিলি জাতি, একটি তফসিলি উপজাতি, একটি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় ও ৭টি সাধারণ পদে কোনও শিক্ষক নেই। এই পরিস্থিতিতে স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যা সাড়ে ছ’শো থেকে কমে ছ’শোয় এসে পৌঁছেছে। অন্ধ্র হাইস্কুলের ছাত্রী এল নিহারিকা, বি সাই কুমারী বলে, “অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছেন। কিন্তু তেলুগু জানা শিক্ষক না থাকায় খুবই অসুবিধা হচ্ছে। অনেক বন্ধুই তো এই স্কুল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।”
খড়্গপুরে আরও দু’টি তেলুগু বিদ্যালয় রয়েছে। মালঞ্চ রোডে ‘তেলেগু বিদ্যাপীঠম’-এ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তেলুগু মাধ্যমে পড়ানো হয়। আর নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রথমভাষা তেলুগু বাদে বাকি বিষয়গুলি ইংরেজিতেই পড়ানো হয়। কারণ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পরীক্ষায় তেলুগুভাষার প্রশ্নপ্রত্র অমিল। রয়েছে শিক্ষকের অভাবও। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মঙ্গলা কেসিএইচ নাইডু বলেন, “শিক্ষকেরা অবসর নিলে আর নতুন শিক্ষক পাচ্ছি না।” ধানসিংহ ময়দান সংলগ্ন ‘মহাকবি গুরজারা বিদ্যালয়ে’র অবস্থা আরও খারাপ। ১৩ জন শিক্ষকের পদে আছেন মাত্র ৫ জন। আগামী মে মাসে আরও একজন অবসর নেবেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শ্রীনিবাস রাও জানান, “আমরা বারবার তালিকা পাঠাচ্ছি। কিন্তু এসএসসি-র বিজ্ঞপ্তিতেই তেলুগু শিক্ষকদের উল্লেখ থাকছে না। ফলে, ভোগান্তি বাড়ছে।”
খড়্গপুর শহরের একমাত্র ওড়িয়া স্কুল ‘উৎকল বিদ্যাপীঠে’ও এক সমস্যা। এই স্কুলটি আবার পুরোপুরি ওড়িয়া মাধ্যমের। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে পড়ুয়া গত বছর এখানে ৪৩০ জন পড়ুয়া ছিল। এখন কমে হয়েছে ৩৯৮ জন। এই স্কুলেও সমস্যা শিক্ষকের অভাব। মাধ্যমিকস্তরে ২২ জন শিক্ষকের মধ্যে প্রধান শিক্ষক-সহ আছেন ১৫ জন। একটি করে তফসিলি জাতি ও উপজাতি, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীর পদ শূন্য। ২০০২ সালে শুরু হওয়া উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য তো একজনও শিক্ষক নেই। একজন মাত্র আংশিক সময়ের শিক্ষক দিয়ে কোনওরকমে সামলানো হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিকের কলা বিভাগ। একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া পার্বতী বেহরা, আকাশ সাহুদের কথায়, “আমাদের স্কুলে তো উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষকই নেই। বাড়িতে গৃহশিক্ষক ছাড়া খুব অসুবিধা হয়।”
অসুবিধা নিয়েই কোনওমতে চলছে স্কুলগুলি। অন্ধ্র হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আর সাই শ্রীধর বলেন, “সংরক্ষিত পদে অন্ধ্রপ্রদেশের জাতিগত শংসাপত্র এ রাজ্যে গৃহীত হয় না। সীমিত সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে কী ভাবে যে স্কুল চালাচ্ছি বলে বোঝানো যাবে না। একই বক্তব্য উৎকল বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ বেহরার। তাঁর কথায়, “১০ বছর হয়ে গেলেও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষক পাইনি। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকও কমছে।”
এই পরিস্থিতিতে কত দিন স্কুল চালানো যাবে, সেটাই প্রশ্ন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.