হুগলির চারটি মহকুমার বেশ কয়েকটি এলাকায় কিছু দিন ধরে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হচ্ছে প্রাচীন কিছু গাছের।
এ পর্যন্ত ১০০টির বেশি গাছ মারা গিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। আবার কিছু গাছ মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে।
কেন?
কী ভাবে ওই গাছগুলি মারা যাচ্ছে তা অবশ্য নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। এ নিয়ে বনদফতর, পঞ্চায়েত বা স্থানীয় প্রশাসনের কোনও হেলদোলও নেই। ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা গ্রামবাসীরা। উঠছে নানা প্রশ্ন। প্রাকৃতিক ভারসম্যের লক্ষ্যে যখন বেশি সংখ্যাক গাছ লাগানোই দস্তুর বলে নিদান দিচ্ছেন প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা, তখনও এ হেন ঘটনায় ঘুম ভাঙেনি প্রশাসনের কর্তাদের। তবে জেলার চারটি মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে গাছ মারা যাওয়ার ঘটনায় নির্দিষ্ট অভিসন্ধি দেখছেন অনেকে।
কী হতে পারে সেই অভিসন্ধি?
যাত্রিবাহী গাড়ি চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি দু’পাশে অনেক সময়ে বিজ্ঞাপনের সংস্থার বড় বড় হোর্ডিংয় পড়ে। কিন্তু গাছের বিস্তৃত ডালপালায় বহু সময়ে বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু ঢাকা পড়ে যায়। তাতে যে লক্ষে বহু খরচ করে ওই সব বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হয়। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে অনেক সময়ই ঘুরপথ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, গাছের মোটা গুঁড়ির মধ্যে হিং বা অন্য কোনও রাসায়নিক দিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোপনে। তারপর গাছ মারা যাচ্ছে। |
অন্য একটি মতে, গাছের লাগাতার মৃত্যুর পিছনে কাঠ-মাফিয়ারা জড়িত। কেমিক্যাল দিয়ে প্রথমে গাছ মেরে ফেলা হচ্ছে। পরে রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতচালিত করাতের সাহায্যে গাছ কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। সূত্রের খবর, এই কাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যাটারিচালিত করাতের সাহায্যে অল্প সময়ে গাছ কেটে দ্রুত ট্রাকে চাপিয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। হুগলির মানকুণ্ডু স্টেশন-লাগোয়া খাঁ-য়ের বাগানে ধানের কুঁড়োর সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে রাতের অন্ধকারে গাছের গোড়ায় ফেলে যেত দুষ্কৃতীরা। মূলত বর্ষাকালকে ওই কাজে ব্যবহার করত তারা। কারণ ভরা বর্ষায় সহজেই সেই কেমিক্যাল মিশ্রিত জল বহু দূরবর্তী বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে অনেক বেশি সংখ্যায় গাছের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। মানকুণ্ডু স্টেশন এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “প্রোমোটারদের চক্রান্তে বিঘের পর বিঘে আমবাগান এখানে উজাড় হয়ে কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে গেল। পুলিশ বা প্রশাসন এই অন্যায়ের প্রতিকারে ব্যবস্থা নিল কই?”
সিঙ্গুরের রতনপুর খালধার, তারকেশ্বর-শ্রীরামপুর ১২ নম্বর রুট, দিল্লি রোড, চণ্ডীতলার মুণ্ডলিকা, আরামবাগের বেশ কিছু এলাকায় এ ভাবে প্রতিদিন শিরিষ, মেহগনি-র মত বহু মূল্যবান গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বনদফতরেরই একটি সূত্রের খবর, শুধু হুগলি নয়, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া প্রভৃতি জেলাতেও এই কাণ্ড ঘটছে। একের পর এক প্রাচীন গাছ শুকিয়ে মারা যাচ্ছে।
পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কাঠ মাফিয়ারা সক্রিয়। বন দফতর বা সংশ্লিষ্ট অন্য দফতরের এ ব্যাপারে বিশেষ হেলদোল নেই। সে জন্যই এমন পরিস্থিতি। নানা কৌশলে গাছ মেরে ফেলা হচ্ছে।” বিষয়টি নিয়ে অবশ্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা হুগলির হরিপালের বিধায়ক বেচারাম মান্না। তিনি বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বন দফতরের সঙ্গে কথা হয়েছে। সিঙ্গুরের রতনপুর-সহ বিভিন্ন এলাকায় গাছ মারা যাচ্ছে।” মরা গাছ হাওয়ায় ভেঙে পড়ে বিপদের আশঙ্কা আছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বন দফতরের একটি সূত্রের খবর, হুগলি বা সংলগ্ন অন্য জেলাগুলিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে গাছ মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট জমি বন দফতরের নয়। যে কারণে বন দফতরের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে ওই সব গাছ আছে বন দফতর বা পূর্ত দফতরের জমিতে। হাওড়া ডিভিশনের অতিরিক্ত বনাধিকারিক ফাল্গুনি মল্লিক অবশ্য বলেন, “বন দফতরের আওতাধীন কোনও গাছের ক্ষতি হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটলে কিছু করার থাকে না।” |