প্রবন্ধ ১...
নাগরিক সমাজ কিন্তু তাঁকে বিশ্বাস করেছিল
নামে ‘আম আদমি’ থাকলেও অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের দল যে একান্তই মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নামে অবশ্য কিছু এসে যায় না মধ্যবিত্তকে যে নামেই ডাকুন, তার চাওয়া-পাওয়ার চরিত্র বদলাবে না। বস্তুত, শহুরে মধ্যবিত্তের চাহিদার কথা মাথায় রাখা প্রথম রাজনৈতিক দল হল এই আম আদমি পার্টি। কেন, গোড়ায় সেই কথাটা খানিক খুলে বলা প্রয়োজন।


ভারতীয় রাজনীতিতে এত দিন সব দলই মূলত মাথা ঘামিয়েছে তাদের নিয়ে, রাষ্ট্রের সব আইন মেনে বেঁচে থাকার উপায় যাদের নেই। তাদের এমন কিছু দাবি থাকে যা মেনে নেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে আইনত সম্ভব নয়। সেই দাবি অন্যায্য কি না, সেটা অন্য প্রশ্ন কিন্তু আইনের পরিধিতে সেই দাবির স্থান নেই। যেমন, ফুটপাথে হকার। যাঁরা ফুটপাথ দখল করে পসরা সাজিয়ে বসেন, তাঁরা পেটের দায়েই বসেন। কিন্তু আইন বলবে, কাজটা বেআইনি। রেললাইনের পাশের জমি দখল করে যাঁরা বসত গড়েন, তাঁরাও নিরুপায় হয়েই বেছে নেন এই ঠিকানা। আইনের সেই নিরুপায়তা দেখার উপায় নেই। আইন এটাকে বে-আইনি জবরদখল হিসেবেই দেখবে। সমাজের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে একটি অর্থে ‘রাজনৈতিক সমাজ’ বলা হয়ে থাকে।
তোমাদেরই লোক

তিনি কার প্রতিনিধিত্ব করবেন, এ বার তা স্পষ্ট করে বলতেই হবে।
দিল্লির জনসভায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: পিটিআই।
এঁদের বড় ভরসা রাজনৈতিক দলগুলো। আইন যে কাজের সম্মতি দেয় না, রাজনৈতিক দলগুলো তা-ই সম্ভব করতে পারে। জনদরদে নয়, ভোটের তাগিদেই। বে-আইনি অটো চালানো, বাড়তি যাত্রী তোলা, রাজনৈতিক অনুগ্রহে সবই সম্ভব হয় বলেই রাজ্যের শাসকের রঙ পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে সব অটোরিকশা ইউনিয়নের অফিস থেকে লাল পতাকা সরে গিয়ে ঘাসফুল উড়তে থাকে হাওয়ায়। আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে, প্রশাসনের চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখে একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক দলগুলি। তার পাশাপাশি, চেষ্টা করতে থাকে, কী ভাবে দু’একটা বেনিয়মকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়। ফুটপাথের এক-তৃতীয়াংশ পথচারীদের জন্য ছেড়ে রেখে বাকিটায় পসরা সাজানো যাবে, বামফ্রন্টের আমলে তৈরি এই সরকারি নিয়ম তার একটা মস্ত উদাহরণ।
এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্য তুলনায় ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠী, ‘নাগরিক সমাজ’। মূলত শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরাই এই গোষ্ঠীভুক্ত। তাঁদের জীবিকার জন্য আইন ভাঙার প্রয়োজন নেই তাঁদের জীবিকা রাষ্ট্রনির্ভর নয়, মূলত বাজারনির্ভর। রাষ্ট্রের কাছে তাঁদের মূল দাবি সেই বাজারের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি। তাঁদের দখলমুক্ত ফুটপাথ প্রয়োজন, তাঁদের সুসজ্জিত নগর প্রয়োজন, শৃঙ্খলাবদ্ধ পথঘাট প্রয়োজন এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দক্ষ প্রশাসন। অর্থাৎ, রাজনৈতিক সমাজ যা চায়, নাগরিক সমাজের দাবি ঠিক তার উল্টো। যেহেতু মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি মূলত রাজনৈতিক সমাজের স্বার্থরক্ষা করে, তাই সেই দলগুলির সঙ্গে নাগরিক সমাজের সম্পর্কের মূল সুর বৈর। নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক দলগুলিকে আইন ভাঙায় প্রশ্রয় দেওয়ার ভূমিকাতেই দেখে, অপছন্দ করে। সাম্প্রতিক কালে গোটা ভারতে, অথবা কলকাতায়, নাগরিক সমাজ যত বারই প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, তার মূলে দাবি ছিল একটাই আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা। নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক সমাজের দ্বন্দ্ব এই আইনের শাসন নিয়ে টানাপোড়েনের সুরেই বাঁধা।
কেজরিওয়ালের রাজনীতির সাফল্যের উৎস এই টানাপোড়েনের মধ্যেই খুঁজতে হবে। নাগরিক সমাজের এক আন্দোলনের সূত্রেই তাঁর গণ-জীবনের সূচনা। তিনি অণ্ণা হজারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন, কিন্তু তাঁর আন্দোলনের মূল প্রশ্নটিকে ছাড়েননি। বরং, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই ‘জেহাদ’-কেই তাঁর দলের প্রধানতম নির্বাচনী কৌশলে পরিণত করেছেন। খেয়াল করা ভাল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবিটি মূলত নাগরিক সমাজের। যাঁরা ফুটপাথে পসরা সাজিয়ে বসেন, যাঁরা নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত যাত্রী তোলেন অটোয়, পুলিশ ঘুষ না নিলে, প্রশাসন আইনরক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে তাঁদের মুশকিল। নাগরিক সমাজের চোখে যা অসহনীয় অনাচার, সেই ‘এলিট’ বৃত্তের বাইরে থাকা বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে তা জীবন-জীবিকার বড় সহায়। কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, সেই প্রশ্ন অনিবার্য। কেজরিওয়াল এবং তাঁর দল, দাঁড়িয়ে আছেন ‘এলিট’ বৃত্তের কেন্দ্রে। যাঁদের নামে তাঁর দল, সেই আম আদমির সিংহভাগের সেই বৃত্তে প্রবেশাধিকার নেই।
একমাত্র দিল্লিতেই এই রাজনীতি নিয়ে ভোটে জেতা সম্ভব। তার প্রধানতম কারণ, দিল্লি শহর, এবং ভারতের রাজধানী। আর কোনও রাজ্যের মোট ভোটারে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অনুপাত যত, দিল্লিতে তার বহু গুণ বেশি। ফলে, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের যে ক্ষোভের জায়গায় কেজরিওয়াল সচেতন ভাবে হাত রাখতে চেয়েছেন, দিল্লিতেই সবচেয়ে বেশি মানুষের মনে সেই সুরের অনুরণন সম্ভব। দ্বিতীয়ত, কেজরিওয়াল তাঁর জেহাদের সঙ্গে সুকৌশলে মিশিয়ে দিয়েছিলেন বিশুদ্ধ সুবিধাবাদ। তিনি বিজলির মাসুল অর্ধেক করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করেছেন। যাঁদের বাড়িতে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছোয়নি, কেজরিওয়াল তাঁদের কথা বলেননি। তিনি জানেন, মধ্যবিত্ত নিজের সুবিধেটুকু পেলেই খুশি।
দিল্লি বিজয়ই যদি তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ শিখর হত, তা হলে এই রাজনীতিই যথেষ্ট ছিল। তিনি বিধানসভায় সন্তুষ্ট নন, লোকসভা নির্বাচনে লড়ে ‘দুর্নীতিমুক্ত সংসদ গড়ে তোলা’র অভিলাষ তিনি জনসমক্ষেই প্রকাশ করেছেন। তিনি বিলক্ষণ জানেন, যে রাজনীতি তাঁকে দিল্লি বিধানসভার অধীশ্বর করেছে, সেই রাজনীতির সাধ্য নেই লোকসভায় দাগ কাটার। সে নির্বাচন মূলত রাজনৈতিক সমাজের পরিসরে লড়তে হবে। সেখানে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব অন্য। ফলে, কেজরিওয়াল জানেন, তাঁর রাজনীতির ভাষা বদলাতে হবে। এমন ভাবে, যাতে গত কয়েক মাসে আপ-এর যে চরিত্র জনমানসে তৈরি হয়েছে, সেটা ভেঙে না পড়ে, আবার তাঁর ‘এলিট’ বৃত্তের বাইরে থাকা মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়। কেজরিওয়াল একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন নাগরিক সমাজ আর রাজনৈতিক সমাজের পরস্পর-বিরোধী চাওয়া-পাওয়াকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলার অদ্যবধি না হাঁটা পথে হাঁটার মুহূর্তে।


কেজরিওয়ালের মস্ত সুবিধা, তাঁর দলের কোনও বৃহত্তর আদর্শ নেই। ফলে, এক প্রশ্নে অবস্থানের সঙ্গে অন্য প্রশ্নে অবস্থানের আদর্শগত সঙ্গতির কথা তাঁকে ভাবতে হয় না। তাঁর মাপকাঠি একটাই দুর্নীতি-বিরোধী যে ‘জেহাদ’ তাঁকে এত দূর এনেছে, তার মূল সুর অক্ষত রেখে ধরে ফেলতে হবে রাজনৈতিক সমাজকে।
যন্তর-মন্তরে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান বিক্ষোভের কথাই ধরা যাক। বিক্ষোভের মুখটি তাঁর আদি জেহাদের সঙ্গে মেলানো। কিন্তু, যে কারণে তিনি দিল্লি পুলিশের ওপর চটেছিলেন, তার সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক নেই। তাঁর মন্ত্রী সোমনাথ ভারতী গভীর রাতে কিছু আফ্রিকান মহিলার বাসস্থানে হানা দিয়েছিলেন, ড্রাগ র্যাকেট আর মধুচক্র চলছে কি না, যাচাই করে দেখতে। পুলিশ, অত্যন্ত আইনসঙ্গত কারণেই, সেই অভিযানে সাহায্য করতে অস্বীকার করে।
অভিবাসী আফ্রিকান জনগোষ্ঠীকে স্থানীয় মানুষ ভাল চোখে দেখে না। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করছে, এই বার্তাটি অতএব ভোট-রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। অনুমান করা চলে, সোমনাথ ভারতী বেআইনি কাজটি কেজরিওয়ালের অজ্ঞাতে কাজটি করেননি। ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে নাগরিক সমাজের নীতি থেকে বিচ্যুতির এটা উদাহরণমাত্র।
আর এক উদাহরণ খাপ পঞ্চায়েত। কেজরিওয়াল থেকে যোগেন্দ্র যাদব, আপ-এর প্রথম সারির নেতারা স্পষ্টই জানিয়েছেন, তাঁরা খাপ পঞ্চায়েতের বিরোধী নন। ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলই খাপ পঞ্চায়েতের বিরোধী নয়, কিন্তু তারা তো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। যে নাগরিক সমাজের মূল দাবি আইনের শাসন, তা চরিত্রগত ভাবে খাপ পঞ্চায়েত নামক সংবিধান-বহির্ভূত, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটির বিরোধী। কেজরিওয়ালরা জানেন, শহরের বাইরে যে বিস্তীর্ণ ভারত, সেখানে পিতৃতন্ত্রই ভরসা। সেই পিতৃতন্ত্রকে সমর্থনের উল্টো পিঠ হল নাগরিক সমাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।


দিল্লি নগর স্বরাজ বিল আনছে আপ। সেই বিল আইনে পরিণত হলে প্রতিটি পাড়ায় তৈরি হবে কমিটি, কোনও প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচন ছাড়াই। সেই কমিটি এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে সিদ্ধান্ত করবে, এবং সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতেই সরকার চলবে।
এই সিদ্ধান্তকে কী ভাবে দেখবেন? গণতন্ত্রকে আরও এক ধাপ গভীরে নিয়ে যাওয়া, না কি নৈরাজ্যের পথে আরও এক পা? দ্বিতীয় আশঙ্কাটি উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। যে ভাবে অনির্বাচিত মহল্লা কমিটির হাতে প্রশ্নাতীত ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন কেজরিওয়াল, তা স্বাস্থ্যকর নয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, মহল্লার কাউকে গ্রেফতার করলে পুলিশকে দু’ঘণ্টার মধ্যে কমিটিকে জানাতেই হবে। যে কোনও সরকারি আধিকারিককে আদেশ দেওয়ার, শাস্তি দেওয়ার অধিকারও থাকবে কমিটির। গণতন্ত্র যে স্তম্ভগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, ভোটের জোয়ারে সেগুলোকে ভাসিয়ে দিতে কেজরিওয়ালের আপত্তি নেই।
এই মহল্লা কমিটির কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ নিতে পারবে না, তদন্তও করতে পারবে না। আশ্চর্য, তাই না? যাঁর উত্থান সম্ভব হল সব সরকারি আধিকারিকের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবির হাত ধরে, তিনিই ক্ষমতায় আসার মাত্র দেড় মাসের মাথায় আইন তৈরি করে কিছু লোককে আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে তৎপর!
কেজরিওয়াল মূলধারার রাজনীতিতে সফল হবেন কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু তাঁর নাগরিক সমাজের রাজনীতিতে যবনিকা পতন হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.