কলিকাতা পুস্তকমেলার বিসর্জনের বাদ্যের মধ্যেই গিল্ড কর্তারা জানাইলেন, আগামী বৎসর হইতে মেলায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হইবে। পুস্তকমেলায় কী করা চলিবে এবং কোনটি চলিবে না, এমন ফিরিস্তি কর্তারা পূর্বেও দিয়াছেন। কিছুই যে বদলায় নাই, তাহাও নহে। কিন্তু যতটুকু বদল হইয়াছে, তাহা বহিরঙ্গের। প্রসাধনিক সংস্কার। পুস্তকমেলার চরিত্রের যে মূলগত সংস্কার দীর্ঘ দিন বকেয়া পড়িয়া আছে, তাহার কথা কেহ বলেন না। পুস্তকমেলা কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে মেলার কর্তারা, এবং রাজ্যের নেতারা বলিবেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে বই পড়িবার সু-অভ্যাস গড়িয়া তুলিবার লক্ষ্যেই এই মেলা। ইহা একটি তত্ত্বমাত্র। মেলা সত্যই মানুষকে বই কিনিতে ও পড়িতে শিখাইয়াছে কি না, তাহা জানিতে অদ্যাবধি কোনও বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা হইয়াছে কি? অভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বলিতেছে, দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক প্রবল নহে। অকাট্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত এই যুক্তিটি ঝুলির বাহিরে না আনাই বিধেয়।
লোকশিক্ষার কারণটি যখন প্রমাণের অভাবে দাঁড়াইতেছে না, তখন কি মেলাটি মূলত বাণিজ্যিক? যদি তাহাই হয়, তবে সরকার এই মেলায় কোনও ভর্তুকি দিবে কেন? মেলাপ্রাঙ্গণ হইতে পুলিশ, পরিকাঠামো হইতে পরিবহণ, সব ক্ষেত্রেই পুস্তকমেলা সরকারি ভর্তুকির উপর নির্ভরশীল। কোনও বাণিজ্যিক মেলাকে এই সাহায্য জুগাইবার প্রশ্ন উঠে না। মেলার যাহা ব্যয়, তাহা সংগঠকদেরই জোগাড় করিতে হইবে। তাহার বাণিজ্যিক মডেল মহাকাশ বিজ্ঞানের ন্যায় জটিল নহে। প্রবেশমূল্য আদায় করিতে হইবে, পুস্তক বিক্রেতাদের নিকট হইতে বেশি ভাড়া আদায় করিতে হইবে। যাঁহাদের সামর্থ্যে কুলাইবে না, তাঁহারা না হয় এই মেলায় আসিবেন না। বিশ্বের প্রায় কোনও বড় পুস্তকমেলাই খুচরা ক্রেতাদের জন্য নহে। সেই মেলায় বইয়ের স্বত্ব বিক্রয় হয়, বাণিজ্যিক লেনদেন হয়। কলিকাতা পুস্তকমেলা ব্যতিক্রম। সেই ব্যতিক্রমী চরিত্র বজায় রাখা হইবে কি না, অথবা মেলাটিকে আংশিক ভাবে হইলেও বাণিজ্যিক লেনদেনের কেন্দ্র করিয়া তোলা হইবে কি না, সবই ভাবিয়া দেখা যাইতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যিক মেলায় ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করিতে হইবে।
সরকার অবশ্য বলিতে পারে, ভর্তুকি অহেতুক নহে, স্থানীয় গ্রন্থ প্রকাশকদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যই মেলায় এই ভর্তুকি দেওয়া হইতেছে। স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া অকর্তব্য নহে। কিন্তু, কলিকাতা পুস্তকমেলা সেই উদ্দেশ্যসাধনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই মেলায় বাণিজ্যের সিংহভাগ ভিন্ রাজ্যের, ভিন্ দেশের প্রকাশকদের ঝুলিতে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের করের টাকায় দিল্লি-মুম্বইয়ের প্রকাশকদের ভর্তুকি দেওয়া নিতান্তই অকর্তব্য। সরকার যদি স্থানীয় প্রকাশকদের কথা ভাবে, তবে মেলার চরিত্রকে তদনুসারে বদলাইতে হইবে। প্রয়োজনে বাহিরের প্রকাশকদের নিকট হইতে প্রকৃত ব্যয় বাবদ টাকা আদায় করিতে হইবে। চাহিলে, তাহার অতিরিক্তও আদায় করা সম্ভব। সেই মূল্য যদি সেই প্রকাশকদের নিকট মেলার লাভযোগ্যতা কমায়, তাঁহারা হয়তো আর আসিবেন না। তাহাতে মেলার আকর্ষণ কমিবে ঠিকই, কিন্তু সরকারের উদ্দেশ্য অর্থাৎ স্থানীয় প্রকাশকদের উৎসাহ দেওয়ার পথে তাহা বাধা নহে। মোট কথা, আগামী বৎসর মেলা বসাইবার পূর্বে ভাবিতে হইবে, এই মেলাটি কেন এবং তাহাতে সরকারের ভূমিকা, যদি আদৌ থাকে, কী। এই সংস্কার না হইলে কোনও প্রসাধনী সংস্কারেই লাভ নাই। |