সি পি আই এম এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাসকে পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর বলিলে হয়তো খুব বেশি অত্যুক্তি হইবে না। ১৯৯৩ সালে জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা হইতে তাঁহার ‘ক্ষুব্ধ’ বিদায় (এবং কিছু কাল পরে প্রত্যাবর্তন) হইতে শুরু করিয়া মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিভিন্ন উপলক্ষে কোঅর্ডিনেশন কমিটি ও সিটু-র মতো দলীয় সংগঠনের সহিত তাঁহার টক্কর ঘটনা বিস্তর। তাঁহার মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ লগ্নে, ২০১১-র জানুয়ারিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতাইয়ে এগারো জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে সম্প্রতি বুদ্ধদেববাবুর প্রকাশ্য জনসভায় ‘ভুল স্বীকার’ সেই ইতিহাসে নূতন সংযোজন। লক্ষণীয়, এই স্বীকারোক্তির কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি দলীয় বৈঠকে মানিয়া লন যে, কথাটি বলিয়া তিনি ভুল করিয়াছেন। এমন আত্মখণ্ডনও ভূতপূর্ব। অতীতেও তিনি শিল্পবাণিজ্য দুনিয়ার প্রতিনিধিদের সভায় তাঁহার দলের বন্ধ ডাকিবার প্রবণতায় ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন এবং দলের তিরস্কার হজম করিয়াছেন। এই পরম্পরাকে খারাপ সম্পর্ক হিসাবে দেখিলে হয়তো ভুল হইবে। মনোবিজ্ঞানের যুক্তিতে, দম্পতির কলহ হয় কি না, দাম্পত্যের গভীরতা তাহার উপর নির্ভর করে না, তাঁহারা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সঙ্গে লইয়া কত সহজে জীবন যাপন করেন, তাহাতেই দাম্পত্যের যথার্থ পরীক্ষা। পার্টি ও ব্যক্তির সম্পর্কেও এই পরীক্ষা প্রাসঙ্গিক। বুদ্ধদেববাবু নিয়মিত স্বাতন্ত্র্যের অভিমান প্রকাশ এবং নিয়মিত তাহার সংবরণ লইয়াই পার্টির সভ্য ও নেতা।
কেবল নেতা নহেন, রাজনৈতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত দলের অন্য নায়কদের তুলনায় গুরুত্ব বা মহিমার দৌড়ে তিনি অনেকখানি অগ্রসর। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডেও তাহার প্রতিফলন ঘটিয়াছে। এই সভার প্রধান আকর্ষণ কে ছিলেন, তাহা বলিবার জন্য কোনও পুরস্কার দেওয়ার প্রশ্ন নাই। সি পি আই এম এই স্বাতন্ত্র্যটুকুকে মর্যাদা দিয়া আত্মশুদ্ধির চেষ্টা না করিয়া আজও দলীয় শৃঙ্খলার আধিপত্যে তাহাকে বিনাশ করিতে বদ্ধপরিকর এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেটুকু নিজস্ব চিন্তা করিতে পারেন, পার্টির ভ্রুকুটি দেখিবামাত্র সেটুকুও চাপা দিয়া ফেলিতে তৎপর। ইহা দুর্ভাগ্য নয়, স্বখাতসলিল। রবিবারের সমাবেশে তাহা নূতন করিয়া প্রকট। এই সমাবেশ দেখাইয়া দিয়াছে, দল এখনও অনেক লোক জোগাড় করিতে পারে। কিন্তু দলের নেতারা, বিশেষত যে ‘তাত্ত্বিক’দের ভোটের ভাবনা ভাবিতে হয় না, তাঁহাদের চিন্তার স্থবিরতা ও দৈন্য এই জনসমাবেশের লোকসংখ্যা দিয়া পূরণ করা সম্ভব নয়।
সমস্যা অচল, অনড় বামপন্থীদের চিন্তার মূলে। তাঁহারা আজও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিপাতনে সিদ্ধ চিন অরুণাচল প্রদেশের অধিকার চাহিলে তাহা অবশ্য সাম্রাজ্যবাদ হয় না, কারণ চিন তো আর আমেরিকা নয়! তাঁহারা পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার পরিসরে দলতন্ত্রের বিষবৃক্ষ রোপণ করিয়া যে পাপ করিয়াছেন, আজও তাহা স্বীকার করিতে নারাজ। এ ক্ষেত্রেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অন্তত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের নূতন আইন করিয়া, স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার দৌড় সেখানেই থামিয়া যায়। ব্রিগেড সমাবেশে ‘উজ্জীবিত’ হইয়া তিনি একটি কথাই ভাবিয়া দেখিতে পারেন। দল আগে, না রাজ্য আগে? তাঁহার দল এখনও এই রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে যাহাতে দলটি জুরাসিক পার্ক হইতে বাহির হইতে পারে, তাহার জন্য দলনায়ক হিসাবে তাঁহার কোনও দায়িত্ব নাই কি? পাশাপাশি, দলেরও কর্তব্য আপন ক্ষুদ্র স্বার্থের উপরে রাজ্যের বৃহৎ স্বার্থকে স্থান দেওয়া। তাহাতে আখেরে দলেরও লাভ। নেতাইয়ে ভুল হইয়াছিল, অন্যায় হইয়াছিল এই সত্য স্বীকার করিলে দলের মর্যাদা বাড়িত। মর্যাদা শেষ অবধি ভোটের পক্ষেও খারাপ নয়। সে কথা প্রকাশ কারাটের বোধের অগম্য হইতে পারে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নয় নিশ্চয়ই। |