|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ধ্বংস না করে পালটানোই ভাল নয় কি
শাশ্বতী ঘোষ |
বীরভূমের লাভপুরে একটি আদিবাসী সালিশি সভা গণধর্ষণের আদেশ দিয়েছিল, এমনটাই জানি সবাই। সালিশি সভা আইনানুগ নয়, এটাও জেনেছি। এ রাজ্যে ৬ শতাংশের নীচে জনসংখ্যা, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, প্রবল দারিদ্র, অপুষ্টি, সাক্ষরতা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার থেকে দূরত্ব এ সব নিয়ে কোনও জনগোষ্ঠীর ভোটব্যাংক হয়ে ওঠা বেশ কঠিন। তাই তাঁরা আদৌ এই সভা ডেকেছিলেন কি না, তা জানার প্রয়োজন বোধ করি না। ঘটনাটিকে মুখতারন মাইয়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এই খোঁজটুকুও নিইনি যে সংবিধান-প্রণেতারা বহু আলোচনার পর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের নিজস্ব রীতিনীতির সঙ্গে তাঁদের সালিশি সভার অধিকার মেনেই নিয়েছিলেন। এ সব খবর নিলে লাভপুরের ঘটনাটি আর প্রথম বাক্যের মতো সরল থাকে না।
সংবিধান ও আদালত
আদিবাসী বলে চিহ্নিত হওয়ার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হল ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা আর নিজস্ব সংস্কৃতি। তার মধ্যে আছে নিজস্ব ভাষা বা সংযোগের মাধ্যম, সাজপোশাক, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মাচরণ, আইন-বিচার। ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাঁদের সমতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং গোষ্ঠীজীবন। সম্পদের অধিকার, পারস্পরিক সম্পর্ক, বিবাহ, এ সব নিয়ে প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। এই নিয়মগুলির বেশ কয়েকটি আমাদের সংবিধান স্বীকৃতি দিয়েছে ২৪৪, ২৪৪এ, ৩৭১এ এবং ৩৭১জি ধারায়। এ ছাড়াও আদিবাসীপ্রধান এলাকার জন্য বাছাই-করা অঞ্চলে (সাধারণত জেলা বা তালুক হিসেবে) মধ্য ভারতের (দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ আদিবাসী মানুষ এ সব অঞ্চলে বাস করেন) ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির জন্য যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফশিল সৃষ্টি হয়েছে। এর বাইরেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বহু প্রথা রয়ে গিয়েছে, যেগুলি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি, কিন্তু গোষ্ঠীর জীবনচর্যার ক্ষেত্রে নিজস্ব গুরুত্ব নিয়েই বলবৎ রয়ে গেছে। সংবিধান প্রণেতাদের মূল উদ্দেশ্য হয়তো ছিল অনাদিবাসী মানুষদের শোষণের হাত থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্ষা করা সম্পদের উপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব অধিকার কায়েম করা বা সুদের ফাঁদে ফেলে তাঁদের জমি বা সম্পদ হারানোর হাত থেকে সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু তাঁদের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা, শহুরে ভাষায় সালিশি, বহাল থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।
কার্যক্ষেত্রে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সরকারের ভূমিকা আদৌ উজ্জ্বল নয়, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে তাঁদের জল-জমি-জঙ্গলের থেকে উচ্ছেদের অভিযোগ বার বার উঠেছে। তাই ১৯৯৬ সালে, বিশেষত পঞ্চম তফশিলভুক্ত অঞ্চলগুলির জন্য প্রণীত হয়েছে পঞ্চায়েত (এক্সটেনশন টু শিডিউল্ড এরিয়াস) অ্যাক্ট (পেসা)। তার ৪ ধারা আর তার বিভিন্ন উপধারা এই জনগোষ্ঠীর গ্রামসভাকে সামাজিক আর ধর্মীয় রীতিনীতি আর প্রথা মেনে জীবন যাপনের অধিকার দিয়েছে। তবে তা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সামাজিক বা ধর্মীয় রীতি থাকলেও পশুশিকার করা যাবে না সেটা অবশ্যই ঘটেছে পরিবেশ সচেতন লবির জোরে। ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড়কে আদিবাসী মানুষরা দেবতার বাসস্থান মনে করেন। এই আইনের ৪(এ) আর ৪(ডি) ধারা মোতাবেক সেই অঞ্চলের গ্রামসভাগুলির সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নিয়মগিরিতে খনি প্রকল্প বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। তা হলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বিচারব্যবস্থাকে প্রশাসন বেআইনি বলে কী করে? হতে পারে বীরভূম পঞ্চম তফশিলের অন্তর্ভুক্ত নয়, কিন্তু সাঁওতালরা এ রাজ্যের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সর্বাধিক অংশ (৫২ শতাংশ)। সুতরাং, সালিশি সভা বসানোর নৈতিক অধিকার বীরভূমের আদিবাসীদের রয়েছেই। কিন্তু বীরভূমের সালিশি সভা বলে যেটি প্রচারিত হল, তা যেহেতু ছিল রাজনৈতিক দলের অনাদিবাসী প্রতিনিধির ডাকা একটি সভা, যাতে আদিবাসী ও অনাদিবাসী সবাই ছিলেন, সেটিকে আদিবাসী সালিশি সভা নয় বলেই দাবি করছেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নানা সংগঠন ও সাঁওতালদের নিজস্ব মাঝিহড়ম। |
প্রান্তে। পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০০৮। ছবি: অমিত দত্ত। |
আমাদের বিচারব্যবস্থা মানুষের কাছে যথেষ্ট পৌঁছতে পারেনি, তা দীর্ঘসূত্রী, তা যথাযথ ভাবে গরিবের কাজে লাগে না, তাই প্রশাসন বা বিচারব্যবস্থার কাছে এ দেশের মানুষ এখনও যান সর্বশেষ উপায় হিসেবে। আদালতে যাওয়া মানে বারংবার দূরের শহরে পয়সা খরচ করে যাওয়া আর পরবর্তী শুনানির দিন জেনে ফিরে আসা, উকিলবাবুদের পয়সার খাঁই, এক আদালতে জিতলে সম্পন্ন প্রতিপক্ষের উচ্চ আদালতের ফাঁসে জড়ানো চলতে থাকে বছরের পর বছর। ক্ষতির শিকার মানুষ তার আগে খুঁজে যান ক্ষতিপূরণের পথ। তাই বাড়ির জ্যাঠা, পাড়ার দাদা, ক্লাব, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত, ইউনিয়ন, সালিশির চাহিদা সর্বত্রই। পশ্চিমি বিচারভাবনা বলে: আইন প্রণয়ন করবে যে, আইন প্রয়োগ করবে যে এবং সেই আইনের ভিত্তিতে বিচার করবে যে, তারা হবে তিনটি পৃথক গোষ্ঠী; না হলে ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকে যায়। আদিবাসী মানুষের চিন্তাভাবনায় এই তিনটি কাজ এক জন করতেই পারেন। সেখানে অলিখিত প্রথার প্রাধান্য, যেটি একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী মান্য করেন। সেখানে নিষেধ নয়, যথাযথ আচরণের উপর জোর দেওয়া হয়। বিচারের মূল উদ্দেশ্য থাকে গোষ্ঠীতে সাযুজ্য আর সংহতি ফিরিয়ে আনা। তাই ব্যক্তি নয়, গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তা গ্রাহ্য হয়। এখানে অভিযুক্ত অভিযোগকারীকে ক্ষতিপূরণ দেবে, যাতে সে গোষ্ঠীতে ফিরে আসতে পারে, না হলে তাকে গোষ্ঠীচ্যুত জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু পশ্চিমি বিচারভাবনা, এমনকী ইংলিশ কমন ল’, যা এ দেশের প্রায় সমস্ত আইনের ভিত্তি, সেখানেই ব্যক্তিই একক, ক্ষতিপূরণ নয়, শাস্তিই বিচারের উদ্দেশ্য। সালিশি সব সময় সবলের পক্ষে আর দুর্বলের উপরে রায় চাপিয়ে দেয়, তা সে পুরুষ হোক বা অর্থবান এ অভিযোগ আছেই। কিন্তু যে ভাবে ‘পেসা’য় পশুশিকার নিষিদ্ধ করা গেছে, সে ভাবে কেন ডাইন বা অন্য কোনও চেহারায় নারীনিগ্রহ, সেগুলি সালিশি বিচারে নিষিদ্ধ করা যাবে না? নিষেধাজ্ঞা জারি না করে কেন সালিশি সভার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা হবে না? সবার বিচার পাওয়ার সামাজিক অবস্থা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত, বিকল্প বিচারের ব্যবস্থা তো এখন আন্তর্জাতিক ভাবেই স্বীকৃত।
রাজ-নৈতিক
আদিবাসীদের জমি অনাদিবাসীরা কেনাবেচা করতে পারেন না। বাস্তবে যে ১৯৬০ সাল থেকেই বীরভূমে নানা কৌশলে জমি হস্তগত করে আদিবাসী মানুষদের ভিটেছাড়া করে খাদান বানানো হচ্ছে এ খবর শহরের প্রগতিশীল মানুষের কাছেও পৌঁছল ২০১২ সালের ৬ নভেম্বর লোবা গ্রামে গুলিচালনার সংবাদের পর। সেখানে জমির আসল মালিক আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে খাদান-মালিকদের এক বিশেষ বৈরিতার সম্পর্কও আমরা তখনই একটু গভীরে বুঝতে পারলাম। জানলাম, শুধু পাঁচামি থেকেই দিনে ১৮০০ ট্রাক পাথরকুচি যায়। ২০০৯-এর এক সমীক্ষা বলেছে, মহম্মদবাজার, রামপুরহাট ১, নলহাটি ১ ও ২ এবং মুরারই ব্লকের ১৩২টি সাঁওতাল গ্রামের ৩৫০০ একর কৃষিজমি, যা সরকার ভূমিহীন আদিবাসী পরিবারদের কাছে বিলি করেছিল, সে জমি বেআইনি ভাবে খাদান-মালিকদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই সমীক্ষা আরও বলেছিল, ভূস্তরের জল নেমে গেছে গড়ে ৫ ফুট, শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে ১২ শতাংশ, বয়স্কদের মৃত্যুর হার ৩৮ শতাংশ আর গত ২০ বছর খাদানে কাজ করছেন এ রকম ৫৮ শতাংশ নারী-পুরুষ মারণ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন।
খাদান অঞ্চল এক রকম আইনকানুনের বাইরে। সেখানে একটি সম্প্রদায়ের হাতে খনির মূল মালিকানা, যারা পেশিশক্তি ও প্রশাসনের মদতে খাদান এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে রাষ্ট্রের যাঁদের সুরক্ষা দেবার কথা, তাঁদের দিচ্ছে না। বরং এত দিন ভাতে মেরে এসে এখন তাঁদের কৌম বৈশিষ্ট্যগুলিকেও নষ্ট করে দিতে উদ্যত। আদিবাসী সালিশি, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ভাষায় মাঝিহড়ম যদি আজ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে প্রশাসন আর বৃহত্তর সমাজের প্রশ্নের মুখে পড়ে, তা হলে কি শোধনের নামে আমরাও এক সাংস্কৃতিক হত্যার শরিক হয়ে যাচ্ছি না? সেই ব্যবস্থার কর্তাভজা দিকগুলিকে সামলে তার সঙ্গে সংলাপ শুরু করা জরুরি নয় কি? না হলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, অনাদিবাসী, রাষ্ট্র আর সংবিধানের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আর অবিশ্বাস আরওই বেড়ে চলবে। সেই দ্বন্দ্বের দায় আরও বেশি করে এসে পড়বে গোষ্ঠীর মেয়েদের উপর, যে মেয়েদের তুলনামূলক স্বাধীনতা বহু অনাদিবাসী মেয়ের কাম্য ছিল। সেই মেয়েটির সুরক্ষার দায় কে নেবে? |
|
|
|
|
|