আমতার গ্রামে গণধর্ষিতা দুই মহিলার নাম প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করে দিলেন তৃণমূলের নেতারা। যে দু’জনের মুখে তাঁদের নাম ঘুরেফিরে এল, তাঁদের একজন তৃণমূল সাংসদ সুলতান আহমেদ, অন্য জন তৃণমূলের হাওড়া জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) পুলক রায়। মঞ্চে তখন বসে রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। আমতায় তৃণমূলের সভায় এই ঘটনায় স্তম্ভিত রাজ্যের মানবাধিকার কর্মী, নারী অধিকার কর্মীরা।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ধর্ষিতা তো বটেই, তাঁর পরিবারেরও কারও পরিচয় প্রকাশ্যে আনা যাবে না। ভারতীয় ফৌজদারি আইনের ২২৮-ক ধারাতে বলা হয়েছে, যৌন নির্যাতনের শিকার মহিলাদের উপর সমাজের আক্রমণ, বা একঘরে করা এড়াতে তাঁদের নাম কখনও প্রকাশ করা চলবে না। শনিবার আমতায় রাজ্যের শাসকদলের সভাতেই লঙ্ঘিত হল শীর্ষ আদালতের নির্দেশ। দুই নিগৃহীতা মহিলার একজনের ভাই, অন্যজনের ছেলেকে মঞ্চে তোলা হল। ঘোষণা করা হল তাঁদের নাম এবং ধর্ষিতা মহিলাদের নাম। |
আমতায় তৃণমূলের মঞ্চে সাংসদ সুলতান আহমেদ এবং আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা
ভট্টাচার্যের পাশে হাজির নির্যাতিতা দুই মহিলার ভাই ও ছেলে। ছবি: সুব্রত জানা। |
গত কয়েকদিন ধরেই দুই নিগৃহীতার আত্মীয়দের নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল। শুক্রবার আমতায় বামফ্রন্টের সভায় বিমান বসু নিগৃহীতা বধূর শাশুড়ি ও শিশুকন্যাকে মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন। শিশুটির হাতে চকোলেট তুলে দেন তিনি। তবে প্রকাশ্যে তাঁদের পরিচয় ঘোষণা করা হয়নি। সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার দাবি করেন, ধর্ষিতার পরিবারের লোকজনই বিমানবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন মঞ্চে উঠে। তাঁর দাবি, “ওই পরিবারের লোকজনকে বামফ্রন্টের মঞ্চে দেখা গেলেও নেতারা কেউ দুই মহিলার, বা আত্মীয়দের নাম বলেননি।”
কিন্তু বিরোধী দলের মঞ্চে যা-ই হোক, খোদ আইনমন্ত্রীর সামনে কী করে ধর্ষিতাদের নাম ঘোষণা হল? চন্দ্রিমাদেবীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এতে বেআইনি কিছু দেখছেন না তিনি। তাঁর যুক্তি, “ওই দুই মহিলা এফআইআর করেছেন। সেখানে তাঁদের নাম রয়েছে। আর তো কোনও গোপনীয়তা নেই। কোনও বেআইনি কাজ হয়নি।” সাংসদ সুলতান আহমেদও বলেন, “এফ আই আর-এ নাম থাকায় এ বিষয়ে গোপনীয়তা কিছু নেই।”
চন্দ্রিমাদেবীর আরও দাবি, কিছু সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যেই ওই দুই মহিলার নাম প্রকাশিত হয়েছে (যদিও সেই সব সংবাদপত্রের নাম বলেননি মন্ত্রী)। তাঁর কথায়, “ওই মহিলাদের ছবি কোথাও ছাপা যাবে না। এমনটা হলে বেআইনি কাজ হবে।”
এ যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছেন আইনজীবী এবং রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য ভারতী মুৎসুদ্দি। তিনি বলেন, “সামাজিক অস্বস্তি, বিপন্নতা এড়ানোর জন্যই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, নিগৃহীতাদের নাম কখনও প্রকাশ্যে আনা চলবে না। সভায় নিগৃহীতার নাম যাঁরা বলেছেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের সেই অভিপ্রায়কে আঘাত করেছেন। প্রকাশ্যে নাম ঘোষণা অপরাধ নয়, সংবাদমাধ্যম ঘোষণা শুনে তা ছাপালেই অপরাধ, এ কথা বলে আইনমন্ত্রী পাশ কাটাতে পারেন না।”
মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র বলেন, “এর আগে জম্ম ও কাশ্মীরের এক মন্ত্রী এ ভাবে প্রকাশ্যে এক ধর্ষিতার নাম বলে দিয়েছিলেন। তাঁকে সুপ্রিম কোর্ট ভৎসর্না করে এবং প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবার নির্দেশ দেয়। ধর্ষিতা নিজে সর্বসমক্ষে নিজের পরিচয় জানাতে না চাইলে, আর কারও তা করার অধিকার নেই।” সভায় নাম ঘোষণাকে ‘আইনি অপরাধ’ বলেই দাবি করেন সুজাতবাবু।
সংবাদমাধ্যমের সামনে গুয়াহাটির এক নির্যাতিতা তরুণীর নাম প্রকাশ করে ফেলায় ২০১২ সালে অলকা লাম্বাকে জাতীয় মহিলা কমিশন ওই ঘটনার তদন্ত থেকে সরিয়ে দেয়। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাজ্যের নারী অধিকার সংগঠনগুলির জোট ‘মৈত্রী’-র তরফে রত্নাবলী রায় বলেন, “আইনমন্ত্রী আইন জানেন না, এটা ভীতিপ্রদ। যদি ভুল করে কেউ ধর্ষিতার নাম বলে ফেলেন, তাহলে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া উচিত। তা যে তিনি হচ্ছেন না, এ থেকে বোঝা যায় যে মহিলাদের প্রতি, বা ধর্ষণ বিষয়টির প্রতি তাঁর দলের অবস্থান কী।”
এ দিন সিপিএম এবং বিজেপির বিরুদ্ধে “সস্তার রাজনীতি” করার অভিযোগ করেন মন্ত্রী অরূপ রায়। তাঁর বক্তব্য, “বিরোধীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে কালিমালিপ্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।” ধর্ষণের ঘটনা থেকে রাজনীতি দূরে রাখতে চাইলে কেন শনিবার নিগৃহীতার আত্মীয়দের তৃণমূলের মঞ্চে আনা হল? স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব দাবি করেছেন, ওই দুই তরুণ নিজেরাই মঞ্চে উঠে অভিযোগ জানাতে চেয়েছিলেন। মঞ্চ থেকে অবশ্য তাঁরা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাননি। দু’জনেই মাইকে বলেন, “আমরা সিপিএমের কেউ নই।
কোনও দলই করি না। দোষীদের
শাস্তি চাই।”
গণধর্ষণের ঘটনার মূল অভিযুক্ত বরুণ মাকাল তৃণমূলের কর্মী বলেই পরিচিত। তাঁকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। এক ধর্ষিতার স্বামী সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, তৃণমূল নেতারাই তাঁকে আড়াল করছেন। শনিবার বরুণের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাজির মন্তব্য, “অভিযুক্ত আট জনের মধ্যে যে সাত জন ধরা পড়েছে, তারা সিপিএম সমর্থক। বাকি অভিযুক্তও যদি তদন্তে দোষী প্রমাণিত হয়, তার কঠোর শাস্তির দাবি করছি।” তৃণমূল সাংসদ সুলতান আহমেদ বলেন, “আইন আইনের পথেই চলবে।”
তবে নির্মলবাবু পুলিশের ‘অতি সক্রিয়তা’ নিয়ে কিছু অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর দাবি, বরুণের বাড়ি থেকে তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে থানায় এনে পুলিশ অত্যাচার করছে।
“এ নিয়ে আমতা থানার ওসিকে
সতর্ক করছি,” বলেন তিনি। জেলা পুলিশ কর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, তদন্তের স্বার্থে যা করার কথা, তা-ই করা হচ্ছে।
এ দিন সভা শেষে সন্ধে ৬টা নাগাদ উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে দুই নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করেন তৃণমূলের বিধায়ক ও মন্ত্রীরা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে চন্দ্রিমাদেবী বলেন, “ভাল চিকিৎসা হচ্ছে। ওঁরা আপাতত ট্রমার মধ্যে আছেন। মনোবিদ পাঠানো হবে। তিনি কাউন্সেলিং করবেন। ধর্ষণের ঘটনায় পুনর্বাসনের যে আইন আছে, সেই মতোই এই দুই পরিবারের ক্ষেত্রেও চিন্তাভাবনা করা হবে।” |