সেলিব্রেশন হল জল দিয়েই। খেলা শেষে মোহনবাগান ড্রেসিংরুমে যখন শ্মশানের নীরবতা, ট্রফি না পাওয়ার হাহাকার। ধানমন্ডি ড্রেসিংরুমে তখন উৎসবের মেজাজ। জল দিয়েই একে অপরকে স্নান করাচ্ছিলেন তাদের ফুটবলাররা।
ফ্রিকিক থেকে রামধনু শটে গোলদাতা সনি নর্ডি তখন বুট জোড়া মুছে তা ব্যাগে তুলে রাখছেন। এক সাংবাদিক এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আপনার গোলেই বাগানের ট্রফি ভাগ্যে এ বারও তালা পড়ে গেল।” বোকা জুনিয়র্সের ‘বি’ দলে খেলার সময় তেভেজের প্রশংসা কুড়োনো নর্ডি প্রথমে বললেন ‘সরি’। তার পর মেসুত ওজিলের ভক্ত যা বললেন তা শুনে চমকে যেতে হয়। “কথা দিয়েছিলাম গোল করব। টেনশনে শুক্রবার রাতে ঘুম হয়নি। আজ ঘুমোব। চ্যাম্পিয়ন হতেই ভারতে এসেছি।”
বাগানে এই দায়বদ্ধতা কোথায়? দেওয়াল লিখনটা কি পড়তে ভুল করেছিলেন করিম বেঞ্চারিফা? না কি ওডাফাকে অতিরিক্ত স্নেহ দেখাতে গিয়ে খালি হাতে বাগানে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস শেষ করার দিকে এগিয়ে চলেছেন সবুজ-মেরুন কোচ।
মরসুম শুরুর দিকেই সমর্থকদের ট্রফি-ভাগ্য ফেরানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “মোহনবাগান এ বার একটা ট্রফি অন্তত পাবেই। আর ওডাফা ওকোলি! অন্য বছরের তুলনায় ফিটনেস-এ অনেক চনমনে মেজাজে রয়েছে।” |
এ ভাবেই বার বার আটকে গেলেন শঙ্কর। শনিবার। ছবি: উৎপল সরকার। |
কিন্তু তা হল কোথায়? কলকাতা লিগ, ফেড কাপে হয়নি। ট্রফি খরার অভিশাপ যে কাটল না ঐতিহ্যের আইএফএ শিল্ডেও। হাতে রইল আই লিগের বাকি ন’টা ম্যাচ। সেখানে ১৫ ম্যাচে ১৮ পয়েন্ট নিয়ে ষষ্ঠ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা করিমের দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা গড়িয়াহাট বাজারে লিও মেসিকে থলি হাতে বাজার করতে দেখার মতোই বিস্ময়কর।
নিট ফল, বিগত তিন মরসুমের মতো এ বারও যে কার্যত ট্রফিহীন ভাবেই বছর শেষ করার দিকেই এগোচ্ছে বাগান। আর করিমের ব্রহ্মাস্ত্র ওডাফা? তিনি তো গোটা মরসুমে বাগানের তেত্রিশটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র পনেরোটি ম্যাচ (কলকাতা লিগে চারটে, আই লিগে সাতটা, ফেড কাপে তিনটে আর আইএফএ শিল্ডে একটা) খেলেই পেশির চোটে কাহিল! তাই শনিবার ডু অর ডাই ম্যাচের শেষ লগ্নে করিমের স্ট্রাইকার ইচে। যিনি এর আগে স্ট্রাইকারে খেলেছেন গোটা কেরিয়ারে মোটে দু’বার। নাইজিরিয়ার অ্যাকাডেমি আর এ বার কলকাতা লিগের এরিয়ান ম্যাচে। দলের এ রকম ভাঙাচোরা অবস্থায় ব্যস্ত শীর্ষ কর্তারাও মাঠে নেই। গঙ্গাপারের ক্লাবেও তাই ‘ট্রফির দেখা নাইরে, ট্রফির দেখা নাই’।
বাংলাদেশের জামালকে কামাল করে সেমিফাইনালে যাওয়া তো দূরের কথা। এ দিন ড্র করে তাদের সামাল দিতেও পারলেন না সাবিথ, জাকিররা। শঙ্করদের সুযোগ নষ্টের ছড়াছড়ি। দু’বার পোস্টে লেগে বল ফিরল। দ্বিতীয়ার্ধে ধানমন্ডির আল্ট্রা ডিফেন্সিভ ফুটবলের সুযোগ নিতে পারল কোথায় মোহনবাগান! শেষ বেলায় ইচে যে সুযোগ হারালেন তা দেখে চোখ বুজে ফেলেছিলেন সমর্থকরাও। এই সব কিছুর জন্য ভাগ্যকে দুষছেন কেউ কেউ। কিন্তু ভাগ্যকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য করিম বেঞ্চারিফাকেও ছেড়ে দেওয়া যায় কি?
চতুর মরক্কান কোচ বলছেন, “সমর্থকদের ট্রফি দিতে পারলাম না বলে খারাপ লাগছে। আর ওডাফার চোট? সে তো উগা ওপারারও লেগেছে! ছেলেরা চেষ্টা করল। কিন্তু সাবিথ, রাম মালিকরা তো আর বিগত বছরে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়নি!” অর্থাৎ ঠারেঠোরে সেই দল নিয়ে কাঁদুনি।
বাংলাদেশের দলটি মাঝমাঠ থেকে উইং কিংবা ডাউন দ্য মিডল একই গতিতে ছ’সাতটা পাস খেলতে খেলতে এগিয়ে আসে বিপক্ষ গোলের দিকে। এর জন্য দরকার ছিল মাঝমাঠে খেলাটাকে শ্লথ করে দেওয়ার। করিম সেটা করার বদলে পাল্টা গতিতে আক্রমণ শানাতে গেলেন। কেন? ধানমন্ডির মাঝমাঠের হৃৎপিণ্ড তাঁদের অধিনায়ক মামিনুল। গোটা দলের গতি, ছন্দ, বল সরবরাহের ‘পাওয়ার হাউস’। মরক্কান কোচ সেই পাওয়ার হাউসের মেইন সুইচটা অফ করতেই পারলেন না। তিনি বরং কবজা করতে গিয়েছিলেন নর্ডিকে। কিন্তু হাইতিয়ান স্ট্রাইকারকে আটকানোর দায়িত্ব যার ওপর ছিল সেই রাম মালিক নর্ডিকে ধরতেই হিমশিম খাচ্ছিল শুরু থেকে। করিমের উচিত ছিল তাঁকে তুলে নেওয়া। কিন্তু গোল খাওয়ার পর তিনি গোটা মাঠকে অবাক করে প্রথমে প্রীতমকে তুলে নিলেন। তার পর রামকে। আর দ্বিতীয়ার্ধে পঙ্কজকে তুলে নামালেন রোয়িলসনকে। অথচ পঙ্কজ যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ সবুজ-মেরুন রক্ষণ বা মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বল হেড দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছিলেন সাবিথ, শঙ্করদের। ফলে সেই বল আসাও বন্ধ হয়ে গেল মোহন আক্রমণ ভাগে। এর পরে ভাগ্য বাগানের হাত ধরে চলবে কী করে?
গোলের সময় শিল্টন জায়গায় ছিলেন না যেমন ঠিক, তেমনই করিমের দলের ফিনিশিংটাও যে ছিল না। বিপক্ষের নাইজিরিয়ান কোচ জানতেন দ্বিতায়ার্ধে উইং এবং ডাউন দ্য মিডল দিয়ে আক্রমণ শানাবে বাগান। ৪-৩-৩ থেকে ৪-২-৩-১ ছকে নাসিরুদ্দিন আর আমিসুকে ‘ডাবল পিভট’ বানিয়ে সেই রাস্তাও বন্ধ করে দেন ধানমন্ডি কোচ। আর তাতেই শেষ সবুজ-মেরুনের শিল্ড জিতে ট্রফি ভাগ্য ফেরানোর আশাও।
মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম (সৌভিক), কিংশুক, ইচে, আইবর, রাম (শঙ্কর), ডেনসন, জাকির, পঙ্কজ (রোয়িলসন), কাতসুমি, সাবিথ। |