বনেদি হোটেলের সাবেক ভোজে ভূতেরই ভবিষ্যৎ
ও যেন ভূতের ভবিষ্যৎ! সমকালের জমিতে পা রেখে সিপিয়া রঙে চোবানো স্মৃতি হাতড়ে স্পষ্ট অবয়বের সৃষ্টি। তার কতটা সত্যি, কতটা নয় তা নিয়ে ধন্দ থাকতেই পারে, কিন্তু রহস্যময় আবছায়ামাখা মিথের স্বাদ নিয়ে কোনও তর্ক হবে না!
কলকাতার কাঠখোট্টা অফিসপাড়ায় হঠাৎই এমন জিয়া-নস্ট্যাল মেজাজ। সাবেক উইলসনের হোটেল তথা দ্য গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের নতুন পথ চলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আছড়ে পড়ছে স্মৃতির সুরভি। ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠা হোটেলের কনফেকশনারি, ‘দ্য বেকারি’র সাজসজ্জাতেই শুধু নয়, স্বাদ-গন্ধেও চেষ্টা চলছে অতীতকে পুনর্গঠনের। সাবেক কেক-পাঁউরুটি তো থাকছেই, খুবই সুলভে হেরিটেজ হোটেলের কয়েকটি পুরনো পদকেও আম-গেরস্তের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন হোটেল কর্তৃপক্ষ।
যেমন? ডিম পাফ বা চিকেন ম্যাড্রাস কারি পাফ। চিজ-বেক্ন ও পেঁয়াজের খুদে কিশ লোরেইন কিংবা মিষ্টি-মিষ্টি হট ক্রস বানও শোভা পাচ্ছে বেকারির কাউন্টারে। ঠিক কত পুরনো এ সব সৃষ্টি, তা জানার প্রামাণ্য নথি কার্যত না-থাকলেও এগুলোকে কলকাতার আদি যুগের টুকিটাকি টাকনা বলাই যায়। পেস্ট্রি কাউন্টারে ক্রিম-বিস্কুট-চকলেটের মিশেলে একটি সাবেক পদ ‘অপেরা’ও আবার এসেছে ফিরিয়া!

হোটেলটির কর্পোরেট শেফ নিমিশ ভাটিয়া বলছিলেন, ধ্বংসস্তূপে খুঁজে পাওয়া রান্নাঘরের সাবেক সরঞ্জাম থেকে কিছু সূত্র মিলেছিল। কেকের খামির বা ডো ঘাঁটাঘাঁটির মিক্সার কিংবা কালিঝুলি মাখা পাউরুটির ছাঁচ উদ্ধার করেও চেষ্টা হয়েছে অতীতের খোঁজখবর করার। পুরনো কয়েকটি পদের নামধামপ্রণালী জোগাড় করা ছাড়াও এই হোটেলের আদি যুগে অর্থাৎ উনিশ শতকে ব্রিটেনে কেমন ভোজরীতি ছিল, সে সব খতিয়ে দেখে মেনু বাছাইয়ের চেষ্টা হয়েছে। হোটেল নির্মাতা ললিত-গোষ্ঠীর পেস্ট্রি-বিশারদ শেফ গ্রেগর লন্ডনে পড়ে থেকে গবেষণা চালিয়েছেন। চিজ-মাংস-ডিমের উনিশ শতকীয় মুচমুচে স্যান্ডউইচ ক্রোক মঁসিউ কিংবা ক্রোক মাদামের মতো পদও গুচ্ছের একেলে স্যালাড-ডেজার্টের সঙ্গে ফিরে এসেছে।
অতীত ও বর্তমানের এমন হাত ধরাধরিই যে টিকে থাকার চাবিকাঠি, সে কথা মানছে কলকাতার অভিজাত চা-ঘর পার্ক স্ট্রিটের ফ্লুরিজও। ফ্লুরিজের শেফ বিকাশ কুমারের কথায়, “রান্না নিয়ে নতুন নিরীক্ষা চালিয়েও অতীতকে মর্যাদা দিতে আমরা ভুল করি না।” তাঁর দাবি, এখনও ফ্লুরিজের শতকরা ৬০ ভাগ খাবারই অন্তত ৫০ বছরের পুরনো। চিকেন প্যাটি, অ্যামন্ড হর্স শু, চকলেট বোট, রামবল-দের গ্রহণযোগ্যতায় কোনও ‘জেনারেশন গ্যাপ’ নেই। অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ওহ্ ক্যালকাটা’ও তাদের প্রচারে ‘একেবারে ঠাকুমার হেঁসেলের সৃষ্টি’ আখ্যাটি ব্যবহার করত।
একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকে যায়। অতীতের স্বাদ-গন্ধের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তা সত্যিই কতটা খাঁটি? ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-খ্যাত চিত্রপরিচালক অনীক দত্তের স্বীকারোক্তি, “অতীত নিয়ে আক্ষেপের পাশাপাশি আমার মধ্যে বর্তমানের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এক ধরনের অস্বস্তি থাকে। তা-ই অতীতকে ফিরিয়ে আনার কথা শুনলে কিছুটা সংশয়ও হয়। এক ধরনের শিক্ষা, নান্দনিকতাবোধ না-থাকলে কাজটা করা শক্ত।”
কিন্তু অতীত মানেই সব ভাল, এটাই বা কে বলেছে? অতীতের মধ্যেও তো একঘেয়েমি থাকতে পারে! আবার সমসময়ের সবটাও হয়তো মন্দ নয়! ফুডরাইটার নন্দন বাগচি এই যুক্তি মেনে নিয়ে বলছেন, “কোনও কিছুই একদম অবিকল ফিরে আসা সম্ভব নয়।” তা হলে পুরনো রান্না নিয়ে কসরত করাকে অতীত-নির্মাণ না-বলে অতীতের এক ধরনের বিশ্লেষণ বা ইন্টারপ্রিটেশন বললে কেমন হয়? প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন আজকের কলকাতার পরিচিত শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ইংরেজি ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ শব্দটিও পছন্দ ‘বোহেমিয়ান’ রেস্তোরাঁর কর্ণধার শেফ জয়ের। এমন ডিকনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণের ছাপ মিলবে কলকাতার ধ্রুপদী মিষ্টির দোকানেও। সিমলের নকুড় নন্দী জনাইয়ের মনোহরার আদলে নলেন গুড়ের খোলস-বন্দি মনোহরা এনেছেন। ভবানীপুরের বলরাম ময়রা সাবেক লেবু সন্দেশের ধাঁচে গন্ধরাজ লেবুর সন্দেশ সৃষ্টিতে সফল। অঞ্জনের ‘ওহ্ ক্যালকাটা’ও সাবেক রান্নার আবেগ উস্কে দিয়েই রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার উপযোগী সমকালীনতা যোগ করেছেন।
নস্ট্যালজিয়া বা অতীতচারিতাকে ইউএসপি হিসেবে তুলে ধরলেও যুগোপযোগী হওয়ার তাগিদটা কিন্তু উড়িয়ে দিচ্ছেন না গ্রেট ইস্টার্ন কর্তৃপক্ষও। শেফ ভাটিয়া বলছিলেন, “এখন সে যুগের গুরুভার ডেয়ারি ক্রিম খাওয়াতে গেলে লোকে মারতে আসবে! তার সঙ্গে স্বাস্থ্য-পরিচ্ছন্নতার ঝোঁকটাও যে আগের থেকে অনেক বেড়েছে এটা আমরা মাথায় রাখছি।”

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.