স্মৃতির শহরে কাল থেকে ফের গ্রেট ইস্টার্ন যুগ
স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে অবশেষে দরজা খুলছে ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল। নতুন নামে। নতুন চেহারায়। কিন্তু ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের সেই পুরনো মিশেলকে অক্ষত রেখে।
আগামীকাল, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অতিথিদের জন্য ফের সুস্বাগতমের ‘লাল কার্পেট’ বিছিয়ে দেবে ১৭৩ বছরের পুরনো এই হোটেল। খুলে দেবে ২৩টি সুইট সমেত ১৯৫টি ঘরের দরজা। সেই সঙ্গে হয়তো খুলে যাবে স্মৃতির সিন্দুকও। কারণ, ক্রিকেটের কিংবদন্তি ফ্রাঙ্ক ওরেল, লেখক মার্ক টোয়েন থেকে শুরু করে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ অতীতে এমন বহু নক্ষত্রেরই পা পড়েছে এই পাঁচতারা হোটেলে।
সেই ২০০৫ সাল থেকে আট বছরেরও বেশি সময় সংস্কারের জন্য বন্ধ থাকার পর গত ১৯ নভেম্বর হোটেলের নব সংস্করণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই উপলক্ষে নিজে ছবি এঁকে তা উপহারও দেন কর্ণধার জ্যোৎস্না সুরিকে। তুলে আনেন শহরের প্রাণকেন্দ্রে অফিস পাড়ায় রাজভবনের ঠিক উল্টো দিকের এই হোটেলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নস্টালজিয়া। আক্ষরিক অর্থেই সেই স্মৃতিমেদুরতাকে উস্কে দিয়ে শনিবার ফের পথ চলা শুরু করবে ভারত তথা এশিয়ার অন্যতম পুরনো এই বিলাসবহুল হোটেলটি।
ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল।—নিজস্ব চিত্র।
এক সময় কলকাতার ‘ল্যান্ডমার্ক’ এই হোটেলের বেকারি থেকে পছন্দের ক্রিসমাস কেক কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়েছে অফিস-ফেরতা মানুষ। সন্ধ্যে গড়াতেই তার রেস্তোরাঁ গমগম করেছে ধনী আর বিখ্যাতদের আনাগোণায়। অর্থনীতির আগল খোলার আগে তুলনায় রক্ষণশীল সমাজেও রমরমিয়ে চলেছে এখানকার রেস্তোরাঁ ও বার ম্যাক্সিমস। ভিড় উপচে পড়েছে নৈশ বিনোদনের গন্তব্যেও। ললিত গ্রেট ইস্টার্নের জেনারেল ম্যানেজার রাকেশ মিত্র অবশ্য জানাচ্ছেন, এখনই নয়, সম্ভবত এ বছরের শেষের দিকে খুলবে ম্যাক্সিমস। তবে হোটেলের বিখ্যাত বেকারি চালু হচ্ছে এখন থেকেই।
২০০৫ সালে ভারত হোটেল গোষ্ঠীর প্রয়াত প্রধান ললিত সুরি ৫২ কোটি টাকায় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ৯০% মালিকানা পকেটে পোরার পর তা সংস্কারের নক্শা তৈরি করে সিঙ্গাপুরের সংস্থা আর্কিটেক্ট-৬১। সঙ্গে স্থানীয় সংস্থা দুলাল মুখার্জি অ্যান্ড অ্যাসোশিয়েটস। সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত র‌্যাফেলস হোটেল সংস্কারের কাজও করেছিল তারা। নতুন করে গড়তে হোটেলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। হেরিটেজ ওয়ান (ভিক্টোরিয়ান ব্লক), হেরিটেজ টু (এডওয়ার্ডিয়ান ব্লক) এবং নতুন (নিউ) ব্লক। সব মিলিয়ে ২৪৪টি ঘর। পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে হেরিটেজ টু এবং নতুন ব্লক খুললেও হেরিটেজ ওয়ানের কাজ শেষ করতে আরও সময় লাগবে। যার মধ্যে আবার ৪৯টি ঘর ছাড়া রয়েছে ম্যাক্সিমস-ও।
এই হোটেলের পথ চলা শুরু ১৮৪১ সালের ১৯ নভেম্বর। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার উপাধির থেকে নেওয়া নামে। অকল্যান্ড হোটেল হিসেবে। পরে সেই নাম বদলে হয় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল। পরে বিভিন্ন সময়ে তা শুধু নগরজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই হয়ে ওঠেনি, উঠে এসেছে সাহিত্যেও। কখনও তাকে বলা হয়ছে ‘জুয়েল অব ইস্ট’, কখনও ‘স্যাভয় অব দ্য ইস্ট’। এমনকী ছোটগল্প ‘সিটি অব ড্রেডফুল নাইট’-এ তার কথা উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং।
নকশাল আন্দোলনের ঝোড়ো দিনগুলির সময় ও পরে অবশ্য বদলাতে থাকে হোটেলের ব্যবসা-ভাগ্য। আর্থিক অনটনে বেহাল হতে শুরু করে পরিষেবা। শুরু হয় শ্রমিক অসন্তোষ। রাজ্য সরকার মালিকানা নেওয়ার পর দফায় দফায় বাধা আসতে থাকে সংস্কারের কাজে। মূলত শ্রমিক সংগঠনগুলির বিরোধিতাতেই ১৯৯৫ ও ২০০২ সালে থমকে যায় হোটেল বিক্রির প্রক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে ডিএফআইডি-র টাকায় শ্রমিকদের স্বেচ্ছাবসর দিয়ে হোটেল নিলাম করে তৎকালীন বাম সরকার।
তখনই গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলটি কেনে ভারত হোটেল। গোড়া থেকেই পরিকল্পনা ছিল ঐতিহ্যশালী হওয়ার কারণে হোটেলের লোহার সিঁড়ি, কিছু আসবাব ইত্যাদি অপরিবর্তিত রাখা হবে। প্রাথমিক ভাবে পরিকল্পনা ছিল ২০০৭-’০৮ সালেই খুলে দেওয়া হবে এর দরজা। কিন্তু ২০০৬ সালে ললিত সুরির আকস্মিক মৃত্যুতে সেই পরিকল্পনা ধাক্কা খায়। অবশ্য সুরির মৃত্যুর ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় ফের সংস্কারের রাশ ধরেন তাঁর স্ত্রী ও বর্তমান কর্ণধার জ্যোৎস্না সুরি। এর পরেও পায়ে পায়ে তাড়া করেছে কখনও প্রযুক্তিগত তো কখনও দখলদারের সমস্যা। শেষমেশ সেই সব পিছনে ফেলে ৩৭৫ কোটি টাকা ঢালার পর দরজা খুলছে হোটেলটি। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন জ্যোৎস্নাদেবী বলেছিলেন, শুধু ৫০০ ট্রাক বোঝাই জঞ্জালই সরাতে হয়েছে সংস্কারের জন্য। ফিনিক্সের উড়ান তো ছাই থেকেই শুরু।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.