লেখা আমার কাছে প্রতিবাদের অস্ত্র। আমাদের লাতিন আমেরিকার গল্পটা এখনও সমাপ্ত হয়নি, ‘আনফিনিশ্ড স্টোরি’। তবু আমরা স্বপ্ন দেখে যাই, বই পড়ে যাই, লিখে যাই। কেন না, সেটাই আমাদের জীবনের অবস্থা বদলাতে পারে, সময়ের ক্ষয়কে পরাস্ত করতে পারে, অসম্ভবকে যে কোনও দিন সম্ভব করে তুলতে পারে। পেরুর লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসার নোবেল ভাষণ টেনে এ বারের অশোককুমার সরকার স্মারক বক্তৃতা শেষ করলেন পেরুর নিবন্ধকার ফ্রান্সেসকা দেনেগ্রি।
ফ্রান্সেসকা ভারতে নতুন নন। চার বছর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার আগে ব্রিটিশ স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে আচমকা জানতে চাইলেন, কালীঘাটের মন্দির কতক্ষণ খোলা থাকে? ইয়োসা, রিকার্ডো পালমা, সিজার মেন্ডোসা বা হাল আমলের সান্তাগলিও রোনকোগলিও পেরুর অনেক লেখকই বাঙালির চেনা। কিন্তু তাঁরা সকলেই পুরুষ। নারীর দৃষ্টিতে ‘পেরুর উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য’ বইমেলার মাঠে এই প্রথম। এবং সেখানেই অশোককুমার সরকার স্মারক বক্তৃতার উজ্জ্বল উদ্ধার। |
ব্লন্ড চুলের এই নারীর বক্তৃতাতে এল সোনার কথা। কলম্বাস স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দকে চিঠি লিখেছিলেন, সোনার খনি এবং দানব, কোনওটিই দেখতে পাননি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার পরেই হাসতে হাসতে ফ্রান্সেসকার সংযোজন: “ওঁরা জানতেন না, পেরুতে কোনও সোনার খনি নেই।” কিন্তু সোনার লোভেই তো পেরু দখল করেছিল স্পেনীয়রা। দুনিয়ার অন্যতম প্রাচীন ইনকা সভ্যতাও ছারখার হয়ে গিয়েছিল উপনিবেশ তৈরির সেই দখলদারিতে। পরেও লাতিন আমেরিকা বারংবার ফিরে তাকিয়েছে উপনিবেশের যন্ত্রণাদায়ক সেই দিনগুলিতে। ‘গত শতাব্দীতেও এক সংস্থাকে বলা হয়েছিল, পানামা যোজকের উপরে রেলপথ তৈরির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। সংস্থা জানিয়েছিল, রেলপথ যেন লোহায় না বানানো হয়। সেই ধাতু এই অঞ্চলে দুর্লভ। বরং তা যেন বানানো হয় সোনায়,’ নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজ। ফ্রান্সেসকার বক্তৃতাতেও ইতিহাসের সেই দুঃখবোধ, ‘কলম্বাস নতুন দেশের অধিবাসীদের ভুল করে ভেবেছিলেন, ভারতীয়। কিন্তু উপনিবেশ তাদের সেই ভ্রান্ত নামেই পরিচিত করাল।’
উপনিবেশের হাত ধরেই এসেছিল আধুনিকতা, এসেছিল নিজের সম্পর্কে নতুন ধারণা। ফ্রান্সেসকার বক্তৃতা মনে করিয়ে দিয়েছিল, উপনিবেশের ইতিহাস সর্বত্র এক। সেখানে বাংলা আর লাতিন আমেরিকার মধ্যে কোনও তফাত্ নেই। ব্রাজিলের মাচাদু দু আসিস আর বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় সমসমায়িক। দু’জনের হাত ধরেই তাঁদের ভাষায়, ইউরোপের শেখানো সাহিত্যকাঠামো ‘নভেল’ বা উপন্যাসের জয়যাত্রা শুরু।
কিন্তু তারও আগে কি ছিল না উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? পেরুর ইনকা গার্সিলাসো দে লা ভেগার কথা বলছিলেন ফ্রান্সেসকা। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের সমসমায়িক পেরুর এই লেখক। স্পেনের করডোবায় যে দিন তিনি মারা গিয়েছিলেন, সে দিন ইংল্যান্ডে মৃত্যু হয়েছে শেক্সপিয়রেরও। ২৩ এপ্রিল, ১৬১৬। গার্সিলাসো বাবার দিক দিয়ে স্পেনীয়, মায়ের দিক দিয়ে ইনকা। অজস্র ইনকা লোকগাথা সংগ্রহ করেছিলেন, ইনকা দৃষ্টিতে স্পেনের বিজয় নিয়েও লিখেছিলেন। পরে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস সে বই নিষিদ্ধ করেন। বইটি পুরো ইতিহাস নয়, কাল্পনিক গল্পগাথা রয়েছে, এমন সমালোচনাও ওঠে। কিন্তু ইতিহাস কি শুধু উপনিবেশের শেখানো কাঠামো? এই বাংলায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘রাজাবলী’ও কি দেশজ দৃষ্টিতে দেখেনি ভারতের ইতিহাস? এ দিনের মঞ্চে অশোককুমার সরকারের স্মৃতিচারণ করছিলেন শংকর। তার আগেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর দুই পারে বাংলা আর লাতিন আমেরিকাকে যেন এক তারে বেঁধে দিয়েছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। অশোককুমার সরকার বক্তৃতা এ বারে ‘কলকাতা ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল’-এর অংশ। সেই উত্সব জন্মাল বহু ত্রুটি নিয়ে। দেড়টার বদলে তিনটেয় শুরু, স্মারক বক্তৃতায় বক্তা হিসেবে ফ্রান্সেসকার বদলে ছাপা রয়েছে প্যাট্রিসিয়া পালাসিওসের নাম। অব্যবস্থার চূড়ান্ত সেই অনুষ্ঠানেও শীর্ষেন্দু বললেন, লেখকের ট্র্যাজেডির কথা। সে নিঃসঙ্গ। তাকে ভাষা, প্রকাশভঙ্গি নিয়ে মনে মনে বহু যুদ্ধ লড়তে হয়। চকিতে গার্সিয়া মার্কোয়েজের সাড়াজাগানো উপন্যাসের নাম মনে পড়ে গেল। লেখকের মনের মধ্যেও তা হলে থেকে যায় শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা? মারিও ভার্গাস ইয়োসার পুরনো এক বক্তৃতার কথা বলছিলেন ফ্রান্সেসকা, ‘কেমন করে লেখক সাহিত্যকে বলবে নিজের একমাত্র দায়িত্ব, যদি তার আশপাশের অধিকাংশ লোক রয়ে যায় নিরক্ষর বা কপর্দকহীন।’ বইমেলা যেন অন্য মাত্রা পেল। সেখানেই এ বারের অশোককুমার সরকার বক্তৃতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন মুহূর্তে নীরবে বাংলা আর লাতিন আমেরিকার জুড়ে যাওয়া। |