|
|
|
|
অন্ধ্র-ছোঁয়ায় বাংলার জলেই এ বার রুই-কাতলা দেদার
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
রুই-কাতলার জন্য আর অন্ধ্রপ্রদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। মাছ-ভাতে বাঙালির রসনাতৃপ্তি করতে ওই রাজ্যই আসছে পশ্চিমবঙ্গে। মৎস্য দফতর সূত্রে খবর, সব ঠিকঠাক চললে সরকারকে অংশীদার করে এ রাজ্যে মাছ চাষের কারবারে নামবে অন্ধ্রের বৃহৎ মাছ ব্যবসায়ী সংস্থা
আনন্দ গোষ্ঠী।
সরকারের বক্তব্য, মাছ উৎপাদনে এ রাজ্য প্রথম হলেও নিজের চাহিদা মেটাতে পুরোপুরি স্বনির্ভর নয়। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রুই-কাতলাতেই, যার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তথ্য বলছে: অন্ধ্র থেকে প্রতিদিন ৫০-৬০ লরি মাছ (এক লরিতে গড়ে ১০ টন মাছ থাকে) ঢোকে রাজ্যে। অর্থাৎ মাসে ১৫ হাজার টন। এই হিসেবে বছরে মাছের ঘাটতি প্রায় দু’লক্ষ টনের কাছাকাছি। অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান, বাঙালি যে পরিমাণ মাছ খায়, তার সবটাই উৎপাদন হোক এই রাজ্যে। এই অবস্থায় অন্ধ্রের সংস্থাটির প্রাযুক্তিক সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গেই পর্যাপ্ত রুই-কাতলা উৎপাদনের ব্যবস্থা করে ঘাটতি পূরণ করতে চায় সরকার। আনন্দ গোষ্ঠীর দাবি, এ রাজ্যে উৎপাদন শুরু করলে দু’বছরের মধ্যেই মাছের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। |
মৎস্য-জোট |
• অন্ধ্রের প্রযুক্তিতে এ রাজ্যেই পর্যাপ্ত রুই-কাতলা |
• রাজ্য সরকার ও অন্ধ্রের আনন্দ গোষ্ঠীর যৌথ সংস্থা |
• জমি-জলাশয় দেবে রাজ্য, খরচ অন্ধ্রের সংস্থার |
• প্রথম দফায় লগ্নি ২০০-২৫০ কোটি |
কী কী পরিকল্পনা |
• মাছের চারা ও দু’তিন কেজি ওজনের মাছ উৎপাদন |
• বাসা (পাঙ্গাস) মাছের ফিলে ও মাছের খাদ্য তৈরির কারখানা |
• মাছচাষিদের প্রশিক্ষণ |
• ভবিষ্যতে চিংড়ি চাষেরও ভাবনা |
|
প্রায় তিন দশক আগে আনন্দ গোষ্ঠীই প্রথম অন্ধ্রের মাছ পাঠাতে শুরু করেছিল এ রাজ্যে। তারাই মাছ চাষে নামার প্রস্তাব দিয়েছে। রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের কথায়, “বাজার এবং বিপণনের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গই মাছ চাষের সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। সেটা বুঝেই আনন্দ গোষ্ঠীর মতো সংস্থা এখানে আসতে চেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও চাইছেন মাছ চাষে স্বনির্ভর হোক রাজ্য। সেই লক্ষ্যেই অন্ধ্রের ধাঁচে সেই রাজ্যের সবচেয়ে বড় সংস্থাকে নিয়ে আমরা যৌথ উদ্যোগে কয়েকটি প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করেছি। অর্থ দফতরের সবুজ সঙ্কেত এবং মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি পেলে আগামী অর্থবর্ষেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।” গত বুধবার এই নিয়ে মৎস্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন আনন্দ গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ইউ কে বিশ্বনন্দ রাজু। তিনি বলেন, “এত দিন অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এ রাজ্যে মাছ রফতানি করেছি। এ বার এখানেই চাষ করে বাঙালির পাতে ‘অন্ধ্রের মাছ’ তুলে দেব। রাজ্য সহযোগিতা করলে চাষিদেরও মাছ চাষে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিতেও আমরা তৈরি।”
মৎস্যমন্ত্রী জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগমের সঙ্গে আনন্দ গোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগে একটি সংস্থা তৈরি হবে। সরকারি জলাশয় ও সংলগ্ন জমিতে প্রকল্প গড়ার ব্যবস্থা করবে নিগম। প্রকল্প তৈরি এবং তার যাবতীয় খরচ দেবে ওই বেসরকারি সংস্থা। প্রথম দফায় তারা বিনিয়োগ করবে ২০০-২৫০ কোটি টাকা। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মাছের চারা ও দু’তিন কেজি ওজনের রুই-কাতলা উৎপাদন, বাসা (পাঙ্গাস) মাছের ফিলে ও মাছের খাদ্য তৈরির কারখানা এবং মাছচাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা। বর্ধমানের তালিতের যমুনাদিঘি, পুরুলিয়ার সাহেববাঁধ, কোচবিহারের রাজাদের বড় দিঘি-বিল এবং মালদহের বড়সাগরের সংলগ্ন এলাকার মধ্যে কোনওটি থেকে কারখানার জমি বেছে নেওয়া হবে।
মৎস্যকর্তারা জানান, প্রতি বছর মাছচাষিদের চারা এবং ডিম পোনা বিলি করতে সরকারের ৬০ কোটি টাকা খরচ হয়। অথচ সেই সেই ডিম পোনা ও চারার গুণমান ‘সার্টিফায়েড’ নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রুই মাছের চারা বা ডিম পোনা চাষিদের দেওয়া হল, অথচ তা বড় হয়ে তেলাপিয়া মাছ হল! কারণ, ডিমপোনার গুণমান যাচাইয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। আনন্দ গোষ্ঠী এই কাজে দক্ষ। অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাড়া এবং ভীমাভরমের দু’টি কারখানায় তারা ডিম পোনা তৈরি করে। এ রাজ্যে সরকারি জলাশয়ে একই জাতের ডিম পোনা তৈরি করা গেলে তার চারা চাষিদের মধ্যে বিনামূল্যে বিলি করবে মৎস্য দফতর। পাশাপাশি, আনন্দ গোষ্ঠী যে মাছ ও ফিলে উৎপাদন করবে, মৎস্য দফতর নিজেই তা বিক্রির ব্যবস্থা করবে। আনন্দের কর্ণধার জানিয়েছেন, সরকার প্রয়োজনীয় জলাশয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে রুই-কাতলার সঙ্গে ভবিষ্যতে চিংড়ির চাষও শুরু করতে চান তাঁরা।
সরকার যে সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ করতে চাইছে, তাদের ব্যবসার বহর কেমন?
আনন্দ গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের দাবি, বছরে তাঁদের সংস্থা ১০০০ কোটি টাকার মাছের ব্যবসা করে। এর মধ্যে ৪০০ কোটি টাকার চিংড়ি রফতানি করা হয় বিদেশে। বাকি ৬০০ কোটি টাকা আসে রুই-কাতলা এবং বাসা মাছের চাষ থেকে।
তাঁর কথায়, “বছরে ৬ লক্ষ টন করে রুই-কাতলা এবং বাসা মাছ উৎপাদন করে আনন্দ গোষ্ঠী। মাসে ৮ থেকে ১০ কোটি চিংড়ি মাছ রফতানিও হয়।” বিশ্বনন্দ রাজু আরও জানান, ১৯৮৭-৮৮ সালে অন্ধ্রের কাকিনাড়া থেকে যখন প্রথম এক লরি মাছ পাঠানো হয়েছিল এ রাজ্যে, হাওড়ার বাজারে তা বিক্রি হয়নি। কেউ কিনতে রাজি না হওয়ায় সেই মাছ বিলি করে দেওয়া হয়েছিল। এই ভাবে তিন দিন মাছ বিলি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা। পরে অন্ধ্রের মাছ নিয়ে বাঙালির সংশয় কাটে। রাজুর কথায়, “তার পর থেকে টানা প্রায় তিরিশ বছর মাছ পাঠাচ্ছি এখানে। বরফ আর তুষ মাখিয়ে। এ বার বাংলাতেই তৈরি অন্ধ্রের জ্যান্ত মাছ খাওয়ানোর পালা।” |
|
|
|
|
|