|
|
|
|
|
|
|
সঙ্গীত সমালোচনা ১... |
|
রাতের চেয়েও অন্ধকার
কে জানত নিজের গানটাই সত্যি হয়ে যাবে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের জীবনে। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। |
বধুঁয়া আমার চোখে জল এনেছে
হায় বিনা কারণে।
নীল আকাশ থেকে
এ কী বাজ হেনেছে
হায় বিনা কারণে॥
দিব্যি পুরনো এই বাংলা আধুনিক শুনে এখনও বাঙালি কাঁদে। বিশেষ করে এখনকার ছেলেমেয়েরা। গানটার রিমেকের শেষ নেই, কিন্তু কাউকে বলে দিতে হয় না এ গান আসলে কার।
এই গানের সুরকার ও গীতিকার জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় আরেকটি সব্বোনেশে কাজ করে বসেছিলেন ওই সেই পুরোনো দিনে। উনি এমন একটা বাণী লিখে, তাতে পাগল করা সুর ঢেলে, অদ্ভুত মাদকতায় গেয়ে দিয়েছেন...
কেউ বলে ফাল্গুন
কেউ বলে পলাশের মাস
আমি বলি আমার সর্বনাশ
কেউ বলে দখিনা
কেউ বলে মাতাল বাতাস
আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস॥
এখনকার ছেলেমেয়েরা শুনি এই কথাগুলোকেই ওদের মনের কথা বলে শুনে নেয়, গেয়ে দেয়। বিলেত, আমেরিকার অনাবাসী বাঙালিরা এই গান চালিয়ে মনে মনে দেশে ফেরেন। আর এঁদের সবারই অগোচরে প্রায়, এর শিল্পী জটিলেশ্বর আশিতে পড়লেন গত ১৩ ডিসেম্বর।
‘আশিতে পড়লেন’ ঠিক শোনাল কি? কী জানি, হয়তো এসে গেল, কারণ ইদানীং জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় একটা না একটা কিছুতে পড়ছেন। শুরু হয়েছিল শরীরে রক্ত নিতে গিয়ে হেপাটাইটিস বি দিয়ে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। তবু মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরতে পেরেছিলেন।
প্রস্টেটের সমস্যা ছিল; কিন্তু বিরাট রক্ষে গানের গলাটা রয়ে গেল সোনালি, নিখুঁত। বরং আরেকটু ওজন এসে, ভাবনা আর মেজাজ জুড়ে, বলতে নেই, আগের থেকেও গভীর ও সুন্দর। ষাট বছর পেশাদারি ভাবে গেয়ে, আর পঞ্চাশ বছর প্রাণ ঢেলে শিখিয়েও কী করে এটা হল সেটা জটিলেশ্বর কপালে টোকা মেরে বলেন “নসিব। এতে আমার কোনও হাত নেই গো।”
জটিলেশ্বরের এই আশ্চর্য, মন কাঁদানো গলাটাই এখন সমস্যায়। সুর লাগালে দেদার সুরে আসছে গলা। কিন্তু দমে দিচ্ছে না। ডাক্তারি পরিভাষায় এই উপদ্রবের নাম ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। সংক্ষেপে সিওপিডি। কেবল গলায় টান নয়, পর পর দশ পা হাঁটলেই দম ছুটে যাচ্ছে। আর হাঁটা থামলেও ওঠানামা থামায় কে! ভদ্রলোক যে থাকেন পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির পাঁচতলায়। এই আশি বছর বয়সে উঠতে-নামতে আশিটা করে সিঁড়ি ভাঙা আর পোষাচ্ছে না জটিল নামধারী সরল, মধ্যবিত্ত মানুষটির।
বললেন, “পাঁচতলা ওঠানামাটাই একটা মানসিক যন্ত্রণা। কোথাও যাওয়া-গাওয়া করা যাচ্ছে না। হপ্তায় একবার একবার নামিউঠি, ক্লাস নিই ঘরে বসে। এ ভাবে আর একটা বছরও পার করব কিনা জানি না।”
এই সিঁড়িভাঙার কথা উঠেছিল যখন, কী অবলীলায় মনে আসছিল এই জটিলেশ্বরেরই একটা যুগান্তকারী রচনা যা অন্ধকারে সিঁড়ি ঠেলে উঠতে উঠতে মাথায় এসেছিল ওঁর।
‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার
ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা!
ও কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার’
গানের গল্পটা সত্যিই শোনার মতো। |
|
বলছেন, এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন, সেই নকশাল আন্দোলনের সময়কালটায়। হঠাৎ কোন এক বাড়িতে কাউকে সেতার বাজাতে শুনে থমকে গেলেন। ভাবলেন, বা রে, এই অন্ধকার রাতে বসে কী সুন্দর ভোরের রাগিণী বাজাচ্ছেন! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনলেন, নিজের বাড়ির দিকে হাঁটলেন, তারপর অন্ধকারেই সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন। আচমকা মনের মধ্যে ওই সুরের পকড়ে কতকগুলো কথাও এসে গেল ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’।
বলছিলেন, “ভাবতে পারো, পুরো গানটাই এসে গেল অন্ধকারে ওই সিঁড়ি চড়তে চড়তে? আর পরদিন গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আগের রাতের সেই বাড়িতে কেউ সেতার বাজায়নি। বাজানো হচ্ছিল সেতারে পণ্ডিত রবিশঙ্করের রাগ ভাটিয়ার। আজ হপ্তাহান্তে একবার ‘গেলাম গেলাম’ করে সিঁড়ি ঠেলে উঠতে উঠতে আর গান আসে না। একটাই প্রার্থনা তখন, বাপুরে, বাড়িটায় একটা লিফ্ট হোক।
সেই লিফ্টও হয়-হয় করে হয় না, কারণ তিনতলা অবধি ছয় ফ্ল্যাট মালিক হাত তুলে দিয়েছেন লিফ্টের খরচ ভাগাভাগিতে নেই। বাকি চার ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দা আবার বছরে নয় মাস কলকাতায় অ্যাবসেন্ট। বেচারি জটিলেশ্বর এই সকলের টাকা মেটাতেও রাজি, তবু কোথায় লিফ্ট!
সব ফ্ল্যাটহোল্ডারের এখন মিলিত যজ্ঞ চলছে ফ্ল্যাটের সাইজ বাড়ানোর। যাতে ইট-কাঠ-পাথর-সিমেন্ট-বালি-সুরকির এক বিপুল কেত্তন বাড়ি ঘিরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলোবাতাস খাওয়ার পরিবর্তে মাফলার-চাদর জড়িয়ে হারমোনিয়াম ধরে গান শেখানো চলে ছাত্রছাত্রীদের। ইংল্যান্ড থেকে ছেলে রাজার ফোন আসে, “বাবা যা টাকা লাগে পাঠিয়ে দিচ্ছি, বাড়িতে লিফ্ট বসাও।” মুম্বইপ্রবাসী বিবাহিত কন্যা শুভা (বড় চমৎকার গায়িকাও বটে), তারও এই একটাই চিন্তা বাবা কী ভাবে শরীরটা সামলাচ্ছে! আর স্বামীর পাহারায় তো আছেনই স্ত্রী বুলু, তিনি নিজেও ভারী অসুস্থ। পাঁচতলা তাঁকেও ঘেরাও করে রেখেছে।
যা পরিস্থিতি এখন শিল্পীর তাতে ওঁর ওই অমর ‘কেউ বলে ফাল্গুন’-এরই একটা (বস্তুত শেষ) স্তবক কী রকম বাস্তব হয়ে ওঠে...
খর বৈশাখে প্রথম যেদিন
মেঘের মিছিলে ওই আকাশ রঙিন,
তৃষিত হৃদয়ে বাজে আনন্দবীণ।
আমি শুনি ঝড়ের পূর্বাভাস॥
শরীর-স্বাস্থ্য, ফ্ল্যাট-লিফ্ট নিয়ে বহু সমস্যা ঠিকই, তবু সব মিলিয়ে, জটিলেশ্বর কবুল করে নেন, কালটা কিন্তু মধুমাস। বললেন, “কী যে আদর পাই, প্রণাম পাই, একটু বেরলেই! আর এত মানুষ যে আমার গান গাইছে ভাবলে অভিমান করার আর কোনও জায়গা থাকে না।”
জটিলেশ্বরের এই মধুমাস চলছে দু’আড়াই দশক। স্বর্ণযুগের অনেক জনপ্রিয় বাংলা গানের যখন একটু-আধটু বয়স ধরা দিচ্ছে, তখন যুগের আড়াল থেকে কী করে, কী করেই যেন আরও অপরূপ চেহারায় বেরিয়ে আসছে অন্য কিছু গান।
সেকালে সেভাবে হয়তো ধরা পড়েনি। জটিলেশ্বরের প্রিয় গায়ক অখিলবন্ধু ঘোষের ‘যেন কিছু মনে কোরো না’, বা ‘সেদিন চাঁদের আলো’ অথবা ‘মায়ামৃগসম’ গানগুলোর মতো সহসা একদিন জটিলেশ্বরের নিজের ‘তোমার সঙ্গে দেখা না হলে’, কী ‘আমার স্বপন কিনতে পারে’, কিংবা ‘আমি ফুলকে যেদিন’ গানগুলোও ঠোঁটে-ঠোঁটে, মনে মনে, মাইকে-মাইকে ঘুরতে শুরু করল।
প্রথম-প্রথম যে চমকে যাননি তা নয়, তবে নিজের পাঁচ প্রিয় গানের এই তিনটি যে নতুন করে ফিরবে এই সরল বিশ্বাসটা ছিল। নেই-নেই করে অ্যাদ্দিনে বারো শ’ গানে সুর করা হয়ে গেল। শ’খানেক গান রেকর্ড করাও হল। গান শেখানো হল কয়েক হাজার ছেলেমেয়েকে।
গান তোলানো হল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, অজয় চক্রবর্তী, হৈমন্তী শুক্ল, বনশ্রী সেনগুপ্ত, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, মনোময় ভট্টাচার্য... কাকে নয়! আফশোস, নিজের কথায়-সুরে গাওয়ানো হয়নি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্তকে।
এই করতে করতেই মধুমাস একটা দশকের পর আরেকটা দশক পেরোল। বললেন, “৫৩ সালে যখন সতীনাথদা’র (মুখোপাধ্যায়) কাছে শিখতে গেছি, পরে চিন্ময় লাহিড়ি মশাইয়ের উচ্চাঙ্গ তালিম নিয়েছি, তখন কি স্বপ্নেও ভেবেছি এই অ্যাদ্দুর আসব? ’৬৩ সালে মেগাফোন থেকে যখন প্রথম রেকর্ড বেরোল সুধীন দাশগুপ্তর সুরে, তখনও কী ছাই এত কিছু ভেবেছি! আর এখন তোমরা বলছ আমার কিছু কিছু গান ছাড়া বাঙালির ঘুম হয় না। আমি তো বলব, সবই নসিব।” বলেই ফের কপালে টোকা দিলেন জটিলেশ্বর।
নিজের কথা-সুরের ক্লাস ও অ্যাপিল নিয়ে একটু-আধটু অহঙ্কারও হয় না? “না, হয় না,” হেসে বললেন জটিলেশ্বর। “এত অকল্পনীয় সব কাজ আগে হয়ে গেছে যে নিজের কাজ নিয়ে লম্বাচওড়া ভাবতেই পারি না। আর হেমন্তদা’র মতো আমারও সেই ভাবনাটাই আসে রবিঠাকুর আর কীই বা বাকি রেখে গেলেন করার!”
কথাটা সত্যি। হেমন্তবাবু বলতেন, বৃদ্ধবয়সে কবি গান রেকর্ড করে দেখিয়েও গেলেন কী ভাবে তাঁর গান গাওয়া দরকার। দারুণ গলা ছিল এক কালে, সেটা ড্যামেজ না হলে লেখা ও সুর করার পাশে গেয়ে রেকর্ডও করতেন আরও মনে হয়।
লেখা, সুর-করা আর গাওয়ার অভ্যাস ছিল কাজী নজরুলের। তবে গেয়ে গেয়েই ধরিয়ে দিতেন অন্যদের। সেই শেখানোর অপূর্ব সব গল্প-অ্যানেকডোট আছে, আর সেভাবেই অন্যের গলায় নিজের ছবি রেখে গেছেন।
অনেক পরে জটিলেশ্বরই বাংলা গানে একের-মধ্যে-তিন। কবি-সুরকার-গায়ক। নিজে এতটাই ভাল গান যিনি, রেকর্ড করলেই হিট, তিনি নিজের সেরা সব বেসিক গানের নির্মাণ অকাতরে বিলিয়ে গেছেন অন্যদের। কষ্ট হয়নি?
ওঁর স্বভাবসুলভ হাসি হেসে বললেন, “তা তো একটু হয়েইছে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে বাপের কষ্ট হয় না?” তবে কষ্টটা বাড়ে যখন দেখেন অন্যের সেই গান বলায়, রেন্ডারিঙে পুরো ছবিটা এল না। |
|
আসলে গান তো একটা গভীর বলা। কবি জটিলেশ্বর এই ‘বলা’ নিয়ে সারা দিন বলে যেতে পারেন। এত পরিচিত কথা-সুরের ‘বঁধূয়া আমার চোখের জল এনেছে, হায়’ বিলকুল একই সুরে, মাপে, অনুভবে বলছেন, কিন্তু প্রতিবার নতুন লাগছে কেন?
বললেন, ‘বলা’। যোগ করলেন, “গানের মাস্টার হয়েও বলছি এই বলাটা শেখানো যায় না। বলা বললে কাদের বুঝি? হেমন্তদা, অখিলদা, মানবদার ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’। গীতা দত্তের ওই পবিত্র কণ্ঠে ‘নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ আকাশে’।”
গাইয়ে মজা পেয়েছেন, এও সত্য। যেমন পিন্টুকে (ভট্টাচার্য) ওঁর এক প্রিয় নির্মাণ ‘আমি ফুলকে যেদিন ধরে বেঁধে’। তারও গল্প আছে।
শ্যামনগরের গঙ্গায় নৌকাবিহার হচ্ছে, নৌকায় পিন্টুও আছেন। তিনি ওয়ার্নিং দিলেন জটিলেশ্বরকে, ‘আমার জন্য দু’টো গান বেঁধে না দিলে ওই নৌকো থেকে জলে ঝাঁপ দেব।’ তখন পিন্টুকে ঠেকানোর জন্য বাঁধা হল ফুলকে ধরে বাঁধার গান। পিন্টুর জন্মদিনে টিভিতে বসেও বলেছেন জটিলেশ্বর, “আহা, বড্ড প্রাণ লাগিয়ে গেয়েছে গানটা!”
এই গান ধরা আর প্রাণ লাগানোর শুরুটাও কম মজার নয় জটিলেশ্বরের। সেই ১৯৫৩-য়। তারও তো হীরক জয়ন্তী হল তাহলে। গল্পটা শুনুন...
জীবনে প্রথম জলসায় গাওয়া হুগলি উইমেনস কলেজে। কী গান দিয়ে? না, ‘পাশের বাড়ি’ ছবির ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা/ হায় কিগো ভরসা, আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে।’ সুরকার সলিল চৌধুরী, গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আজকের বাগবুলিতে সুপারডুপার হিট গান।
ধনঞ্জয়ভক্ত জটিলেশ্বর বলে বলে পাঁচ বার টিকিট কেটে ‘পাশের বাড়ি’ দেখে এই গান গলায় তুলে নিয়েছিলেন। তা গাইতেই বেদম হাততালি আর অর্গানাইজারের নয়ন-ইশারা ‘গেয়ে যা’। সব চেয়ে বড় তারিফ এক বন্ধু ছুটে এসে বললে, “বাড়িতে বসেছিলাম। চমকে উঠেছি ধনঞ্জয়বাবু এসেছেন নাকি! পরে তোর নাম শুনেই ছুটে এলাম।”
এক বাংলার অধ্যাপক বললেন, “একটা পর্দা ফেলে দিলেই ব্যস! ধনঞ্জয় গাইছেন।”
আসলে জটিলেশ্বর তখন উঠেপড়ে খুব ধনঞ্জয়ের গান গাইছেন, ওঁর গানের ভঙ্গি আর আওয়াজ নকল করে। তো এই জলসার ‘ডেবিউ’ একটা যোগ সৃষ্টি করল। কলেজের এক দাদা গোছের একদিন ডেকে নিয়ে হাজির করল তাদের বাড়িতে। কারণ? সতীনাথদা’র সঙ্গে দেখা করাবে। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়!
সতীনাথবাবু ওঁর সেবারের পুজোর গান দু’টো শোনালেন। ‘এ জীবনে যে আর কিছু ভাল লাগে না’ আর ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম।’ ঘরময় লোকের সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবে শোনা হয়েছে গানগুলো, হঠাৎ করে দাদার সার্টিফিকেট ভেসে উঠল, “জটিল কিন্তু বেশ গায়। আপনার গানও জানে।”
ওজর আপত্তি শেষে ‘জয় কালী’ বলে গাইতে হয়েছিল সতীনাথবাবুরই একটা গান ‘আমি খেলায় থাকব মেতে, তবু তোমায় ডাকা ভুলব না।’
গান থামাতে দেখেন সতীনাথ স্থির দৃষ্টিতে ওঁকে দেখছেন, জিজ্ঞেস করলেন, “আমার গান ছাড়া আর কার গান জানো?”
নার্ভাস জটিলেশ্বর বললেন, “শচীনদেব, ধনঞ্জয়বাবু, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।”
সতীনাথ বললেন, “দেখি গাও তো!”
জটিলেশ্বর প্রথমে ধরলেন শচীনদেবের ‘মালাখানি ছিল হাতে।’ একটুখানি গাইলেন, তারপর ধরে নিলেন ধনঞ্জয়বাবুর ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা।’
গান শেষ হতেই হারমোনিয়াম (যেটা উনিই বাজাচ্ছিলেন) বন্ধ করে বললেন সতীনাথ, “বুঝলি শ্যাম (বন্ধুর দাদা), এ তো নকল করতে করতে নিজের গলাটাই হারিয়ে ফেলেছে। তবে চেষ্টা করলে নকলের চলটা চলেও যায়।”
তার পর জটিলেশ্বরকে বললেন, “শোনো, তোমার পরীক্ষা শেষ হলে আমার কাছে চলে এসো।”
সেই যে পরীক্ষা শেষ করে একডালিয়া প্লেসে সতীনাথবাবুর বাড়ি যাওয়া শুরু হল তাতেই জীবনের রাস্তা বাঁধা হয়ে গেল জটিলেশ্বরের। তার পর?
তার আর পর নেই, শুধু গেয়ে যাওয়া, লিখে যাওয়া, লেখা হলে সুর বসিয়ে যাওয়া, দুপুর-সন্ধে শিখিয়ে যাওয়া, ডাক এলে জলসায় বসা, কোম্পানি চাইলে গান রেকর্ড করা..... গত অর্ধশতাব্দী একটা লং প্লে ডিস্কের মতো বেজেই চলেছে জটিলেশ্বরের জীবন। “গানে-গানে বড় সুখে কেটেছে জীবনটা গো,” বললেন শিল্পী।
তা এত সুন্দর বাংলার হাত যাঁর, তিনি এত কাল হাত গুটিয়ে বসেছিলেন কেন? প্রশ্নটা ওঁর কাছে রেখে ফেলেছিলাম বেশ কিছুকাল আগে। তখন মুচকি হেসেছিলেন, তার পর বছরখানেক আগে সব্বাইকে চমকে দিয়ে বার করলেন জীবনস্মৃতির অপূর্ব পাণ্ডুলিপি ‘দিনগুলি মোর’। আরও ক’দিন পর তা বই হয়ে বেরোলো।
তবে দীর্ঘ দিন আগেই প্রকাশ পেয়েছিল ওঁর লেখা গানের সঙ্কলন। গানের নামে নাম ‘এ কোন সকাল’। শহরে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলে যে লাইনটা দিয়ে পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়।
অ্যাদ্দিনে বাংলা গানের সমাজে কিন্তু একটা চর্চা চালু হয়েছে জটিলেশ্বরের গানের ম্যাজিকটা কী?
চর্চাটা ঠিক আজকেরও নয়, আকাশবাণীর সেই ‘লাইভ’ সুগম সঙ্গীতের সময় থেকেই। সহসা একদিন একটা পাতলা গলায়, ভয়ানক সুরে, নিখুঁত ঝোঁকে-ফাঁকে অপূর্ব তিনটি গান ভেসে উঠল। লম্বাটে আর বেশ জটিল একখান নাম। ক’দিন যেতে রোগাসোগা, সরু গোঁফঅলা, সৌম্য-ভদ্র চেহারার একটা ছবি এল ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায়। সঙ্গে নাম জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
আজকের মতো সেদিনও চর্চা ছিল এত অন্য রকম কেন ওঁর গান?
ধনঞ্জয়, সতীনাথের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে এমন এক স্বতন্ত্র ধ্বনি হিসেবে দেখা দিলেন জটিলেশ্বর, যার ম্যাজিক দিনে দিনে আরও রহস্যময় হয়েছে। জিজ্ঞেস করলে সেই পুরোনো শব্দটাই ফিরিয়ে আনবেন বলা।
কিন্তু ‘গড়া’ বলছেন না কেন? ‘কেউ বলে ফাল্গুন’-এ সর্বনাশ আর দীর্ঘশ্বাসের কথা বলছেন, অথচ যন্ত্রানুষঙ্গে বিয়ের সানাইয়ের মতো ওই যে একটা সুর বেজে চলেছে কী ‘উইট’ ওই প্রয়োগে!
কিংবা ‘বঁধূয়া আমার চোখে’ গানে এমন একটা কথার মজা সঞ্চারীতে...
‘আমি বাদী আমি বিবাদী
কোথা উধাও অপরাধী
কেন সেই রূপের আগুন বুকে জ্বেলে
আছি বেঁচে হায় বিনা কারণে॥
চোখে জল আনার গানই বটে, কিন্তু একেবারে করুণ করুণ কথা না বলে এত ভাবাচ্ছে কেন? এই ভাবনাটাই গানের উদ্দেশ্য। যা বাংলা আধুনিকের মধ্যেও এত আধুনিক করেছে ওঁর গানকে। এত hummable, গুনগুনোবার মতো, আর এত shock-magic জাদুচমক পদে পদে। জটিলেশ্বর নিজের মতো এক পূর্ণ ঘরানা। ভারত ক্রিকেটের রাহুল দ্রাবিড়ের মতো, কাজের শেষ নেই, কিন্তু প্রচার থেকে হঠ্কে। রাগরাগিণীতে ভরে আছে কিন্তু লাগাবেন শুধু ওইটুকু, যা কথা চাইছে। জায়গা মতো নিয়ে নেবেন। আর শেষ কথা বলবে ‘উচ্চারণ’। যে শব্দটাকে জটিলেশ্বর খুব সরল করে বলেন ‘বলা’।
এই বলার গলাটুকু বাঁচাতেই আপাতত জটিলেশ্বরের তাবৎ মেহনত। গলা কী সুন্দর ওঠে নামে, শরীর পারে না। ছবি তোলানোর জন্যও একবার নীচের মাঠে নামা গেল না। কোমরে যন্ত্রণা।
কী জটিলতা!
শেষ অবধি এই জটিলতাগুলোই জটিলেশ্বরকে এত বিচিত্র ও আধুনিক রাখে। ওঁর প্রেমের গান আজকের নবীনদের টানে কারণ তাতে কোথায় যেন একটা লুকোনো মনের সমস্যাও থাকে। গজলের শের-এর মতো একটা রঙিন মোচড়। একটা সময় পাগলের মতো মেহদি হাসানের গজল তুলেছেন, তা নিয়ে মাথা খাটিয়েছেন। সেই ধারায় কিছু কম্পোজও করেছেন। গানে কবিতাকে খুব মান্য করেছেন।
নিজের ঘরে একটেরে হয়ে পড়া থেকে কী গান বেরোবে বলা যাচ্ছে না, যদিও এই গল্ফ গ্রিনে পাকা বসত করার আগে শহরের উত্তর ও দক্ষিণ পল্লি মিলিয়ে কম আস্তানায় দিন গুজরান হয়নি জটিলেশ্বরের। বন্ধুদের সঙ্গে বিছানা শেয়ার করে থাকা, মেসে-হোটেলে পাত পাড়া, বাগবাজার টু জনক রোড। একবার তো মেসের খাটে লম্বা হতে গিয়ে লম্বা মেসমেট দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ের ঠেলায় জলের কুঁজোটা ভেঙে চৌচির হল।
কিন্তু ওরই মধ্যে নিজের কথা ও স্বরলিপি লিখে গেছেন জটিলেশ্বর। সারা দিন ঘাড় গুঁজে সরকারি অফিসে চাকরি করেছেন। ডেলি প্যাসেঞ্জারি, ট্রাম-বাস পাল্টে পাল্টে গুরুদের কাছে শিখতে যাওয়া, মধ্যবিত্ত জীবনের সব হ্যাপা সামলেছেন।
শুধু ওই একটা সুখের জন্য একটু একলা হতেই গান আসবে। তাতে জীবনের সঙ্গে রোম্যান্স ওঁর বেড়েছে বই কমেনি। যে রোম্যান্স টুক টুক করে সাজিয়েছেন ওঁর গানে। শুধু মন দেয়া-নেয়া আর মন ভোলানো গান বেঁধে কাজ সারতে চাননি, গানকে কিছুটা ডায়েরি, কিছুটা আত্মজীবনীর মতো গড়তে চেয়েছেন।
সে জন্যই না ‘বলা’ নিয়ে এত উৎকণ্ঠা শিল্পীর। সে জন্যই না এত আদর ইদানীং শিল্পীর। আর সে জন্যই না শিল্পীদের কাছে তিনি শিল্পীর শিল্পী!
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
|
|
|
|
|