লিন্ডসে স্ট্রিট পেরিয়ে জাদুঘরের দিকে যেতে যেতে ফটাফট করে ক্যামেরায় ছবি তুলছিলেন পার্ক সার্কাসের মৃদুল রক্ষিত।
রাস্তার বাঁ দিকে ফুটপাথে কোনও হকার নেই। রাস্তা থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ফিরপো মার্কেটের বাড়িটা। তার পরের প্রতিটা শোরুমে কী কী জিনিস সাজানো রয়েছে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তা। রাস্তায় কোনও মানুষ নেই। জওহরলাল নেহরু রোড দিয়ে মসৃণ ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। মানুষের ভিড়ে ঠোক্কর খেতে হচ্ছে না।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মৃদুলবাবু। রাস্তার ধারে এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, ‘চৌরঙ্গির ফুটপাথ কি এ বার থেকে এমনই থাকবে?’ পুলিশ সার্জেন্টের জবাব শুনে মোবাইলে নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধদের ফোনে একবার ধর্মতলায় আসতে অনুরোধ করতে শুরু করলেন মৃদুলবাবু। কারণ সার্জেন্ট বলেছেন চৌরঙ্গির এই হকারমুক্তি সাময়িক। বড়জোর রবিবার দুপুর পর্যন্ত।
কেন? লালবাজার জানাচ্ছে, চৌরঙ্গির এই ভোলবদল সাময়িক। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রবিবার সকালে ভারতীয় জাদুঘরের অনুষ্ঠানে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষীদের অনুরোধেই সাময়িক এই হকার উচ্ছেদ। অর্থাৎ রবিবার বিকেল থেকে এই ‘নতুন’ চৌরঙ্গি দেখার সুযোগ না মিলতেই পারে। |
মহানগরীর কোন রাস্তায় হকার বসবে, কোথায় বসবে না, তা ঠিক করে কলকাতা পুরসভা এবং কলকাতা পুলিশ। হকার উচ্ছেদের দায়িত্ব ওই দুই সংস্থার। কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। আমার কোনও ধারণাই নেই।”
অর্থাৎ, এ ব্যাপারে সরকারি কোনও নীতি হলে তা পুরসভার মেয়রের অন্তত জানার কথা ছিল। লালবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুরোধ মেনেই তাঁর নিরাপত্তার কথা ভেবে এই ব্যবস্থা।
লালবাজারের দাবি, এই সাময়িক হকার উচ্ছেদের জন্য কোনও রকম জোর খাটাতে হয়নি তাঁদের। এক পুলিশ কর্তা বলেন, “আমরা অনুরোধ করেছিলাম মাত্র। ওঁরা (হকারেরা) নিজেরাই উঠে গিয়েছেন।”
অস্থায়ী সব কাঠামো খুলে নেওয়ার পরে এ দিন চৌরঙ্গির চেহারাই যে ফিরে গিয়েছে তা অস্বীকার করছেন না হকারেরাও। বিধান মার্কেটের গায়ে অস্থায়ী কাঠামো লাগিয়ে ব্যবসা করেন মহম্মদ নাসিম। নাসিম শুক্রবার সন্ধ্যায় দাঁড়িয়েছিলেন লিন্ডসে স্ট্রিট সংলগ্ন ফুটপাথে। পিছনে ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। সামনে কিড স্টিটের মোড় পর্যন্ত ফুটপাথে ছিল না কোনও বাধা। নাসিমের অস্থায়ী ডেরা পর্যন্ত ভাঙা পড়েছে। চৌরঙ্গির নতুন চেহারা দেখে নাসিম নিজেও অবাক। তবে এটা কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না বলে মনে করেন তিনি। নাসিম বলেন, “ওই দোকান থেকেই তো গোটা পরিবারের পেট চলছে। দোকান উঠে গেলে খাব কী? শনিবার খুব ভাল ব্যবসা হত। এ শনিবার তা মার খাবে।”
পুলিশ কিন্তু চায় চৌরঙ্গির এই চেহারাটাই বরাবরের মতো থাকুক। পুলিশ চাইলেই কি তা সম্ভব? লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “আমরা চৌরঙ্গি এলাকা থেকে হকার তুলে দিতেই চাই। বহুদিন ধরে এই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছি। কিন্তু হকার তোলাটা পুরো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। পুলিশ প্রস্তাব দিতে পারে মাত্র।”
কিন্তু স্থায়ী ভাবে ধর্মতলার ফুটপাথ থেকে উঠে যেতে নারাজ হকার নেতারা। সিটু-র হকার সংগঠনের নেতা মহম্মদ নিজামুদ্দিন বলেন, “কেন্দ্রীয় হকার নীতি অনুযায়ী ফুটপাথের এক-তৃতীয়াংশ জায়গায় হকারদের বসতে দিতে হবে। ফুটপাথ থেকে চিরকালের জন্য হকার তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।”
এক পুলিশ সার্জেন্টকে দেখা গেল সন্ধ্যার মুখে ডোরিনা ক্রসিং থেকে জাদুঘর পর্যন্ত ফুটপাথের ছবি তুলে রাখছেন। অনেকেই চান, প্রধানমন্ত্রী এই এলাকায় বারে বারে আসুন। তা হলে অন্তত শহরের এই অংশটা পুরনো চেহারা ফিরে পাবে। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে পারবেন মানুষ। অযথা যানজটের কবলে পড়বে না মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র। |