হারিয়ে যাচ্ছে লাল শাঁখা। সেই সঙ্গে বিস্মৃত হতে যাচ্ছে বীরভূমের এই সাবেক শিল্পও। লাল শাঁখা শিল্পীদের অনেকেই বংশ পরাম্পরার এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা ধরেছেন।
বিয়ে বাড়িতে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরা কনের হাতে লাল শাঁখা পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়ে-বউরা উলু ও শঙ্খ ধ্বনি দিচ্ছেন। এই দৃশ্য আজও রয়েছে। কিন্তু সাদা শাখা ও লালপলা পরার রেওয়াজ আজও থাকলেও লাল শাঁখা পরার চল কমে যাচ্ছে। দেবী প্রতিমা বরণে শুধু বরণডালায় নানা অনুষঙ্গের পাশে রয়ে গিয়েছে লাল শাঁখা। এ ভাবেই অস্তিত্ব-রক্ষার সঙ্কটে মুখে দাঁড়িয়েছে এই শিল্প ও শিল্পীরা।
গ্রাম বাংলায় নানান মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে শাঁখা বললেই আগে যে শাঁখার কথা বোঝানো হত, তা সাদা নয় লাল শাঁখা। এখনও যে লাল শাখার চল নেই তা একেবারে বলা যায় না। তবে বেশ বছর কয়েক আগের সেই লাল শাঁখার যে চল ছিল তা ধীরে ধীরে কমতে কমতে বর্তমানে তলানিতে ঠেকেছে। সেই সঙ্গে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরাও আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন। |
তৈরি হচ্ছে লাল শাঁখা। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত। |
দুবরাজপুরের কুখুটিয়া, বোধগ্রাম বা ইলামবাজার ব্লকের শীর্ষার কয়েক ঘর লাল শাঁখা শিল্পীদের ঘর ঘুরে শুধুই দৈন্যতার ছবি দেখা গিয়েছে। কেন এই দুরাবস্থা? তাঁদের মতে, চাহিদার অভাব ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির যৌথ আক্রমণে এই শিল্প বর্তমানে ধুঁকছে। তাঁদের মতে, চাহিদা বৃদ্ধি না পেলে এবং কাঁচামালের দাম শিল্পীদের নাগালে না এলে লাল শাঁখা অচিরেই হারিয়ে যাবে।
দুবরাজপুরের কুখুটিয়ায় প্রায় ৫০ বছর ধরে লাল শাঁখা তৈরি করছেন যতন দত্ত। এখনও তিনি এলাকার বিভিন্ন গ্রামে বিয়েতে কনেকে নিজের হাতে লাল শাঁখা পরিয়ে আসেন। তাঁর কথায়, “এখনও এই শিল্পকে আঁকড়ে রয়েছি। কিন্তু ক্রমহ্রাসমান চাহিদা ও ক্রমবর্ধমান কাঁচামালের জোগান সামলে দিনে গড়ে ৫০-৬০ টাকার বেশি আয় হয় না।” ওই গ্রামের আর এক শাঁখা শিল্পী সুবোধ দে বলেন, “সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খুব পরিশ্রম করেও ১৫ জোড়ার বেশি শাঁখা তৈরি করা যায় না। দুবরাজপুর, রাজনগর, খয়রাশোলের দশকর্মার দোকানগুলোতে শাঁখা বিক্রি করি। কিন্তু এত খেটেও দিনে গড়ে ৬০-৭০ টাকার বেশি রোজগার হয় না।” ইলামবাজারের বসন্ত দাস এবং তাঁর কাকা শিশির দাসও একই কথা বলেছেন। এই শিল্পীদের অনেকেই এখনও হস্তশিল্পীর সচিত্র পরিচয়পত্র পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। ফলে ওই পরিচয়পত্র দেখিয়ে যে সব সুবিধা পাওয়ার কথা তা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। শিল্পীরা জানান, গত কয়েক বছর আগেও প্রায় ৫০ ঘর শিল্পী এই পেশায় ছিলেন। এখন প্রবীণ কয়েকজন শিল্পী এই কাজ করলেও নতুন প্রজন্ম এতে আগ্রহী নয়। তাঁদের অনেকে জনমজুরি খাটছেন, কেউ বা ধারদেনা করে দোকান খুলেছেন।
সমস্যাটা মূলত কোথায়? শিল্পীর জানাচ্ছেন, এখনও রীতি মেনে পুজো বা বিয়েতে গৃহস্থেরা শাঁখা ব্যবহার করেন ঠিকই, তবে এখন লাল শাঁখার বদলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাদা শাঁখা ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে শাঁখা শিল্পীদের মধ্যে কিছুটা স্বচ্ছল দুবরাজপুরের বোধগ্রামের বিশ্বনাথ সেন। তিনি ওই শিল্পীদের কাঁচামাল জোগান দেওয়ার পাশাপাশি নিজে সাদা শাঁখার ব্যবসাও করেন। সাদা শাঁখার বাজার থাকলেও লাল শাঁখার শিল্পীরা কেন সাদা শাখা তৈরি করছেন না? ওই শিল্পীদের বক্তব্য, ছোট থেকেই বাপ-ঠাকুরদার হাত ধরে লাল শাঁখা তৈরির কাজ তাঁরা শিখেছেন। নতুন করে সাদা শাঁখা তৈরি করার ঝুঁকি তারা নিতে পারছেন না।
জেলা শিল্প দফতর সূত্রের খবর, এই কাজে প্রশিক্ষণ বা অন্য কোনও সাহায্য চেয়ে এখনও পর্যন্ত কেউ আবেদন করেন নি। দুবরাজপুর ব্লকের শিল্প উন্নয়ন আধিকারিক অলয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পরিচয়পত্রের জন্য কুখুটিয়ার একজন শাঁখা শিল্পী আবেদন জানিয়েছিলেন। ওই শিল্পীরা বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছেন এবং তাঁদের প্রশাসনের তরফে কোনও ভাবে সাহায্য করা যায় কি না, তা দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।” |