নন্দীগ্রামের মামলা এত সোজা নয়, তোপ নেত্রীর
ন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই-তদন্তই চেয়েছিলেন তিনি। প্রায় সাত বছর বাদে মামলার চার্জশিট পেশের পরে সেই সিবিআই-কেই এক হাত নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার দলের ব্রিগেড সমাবেশের মঞ্চ থেকে কেন্দ্রীয় তদন্ত-সংস্থাটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, “আন্দোলনকারীদের গায়ে হাত পড়লে তারা বুঝে নেবে। মামলা এত সোজা নয়। খেলাও এত সহজ নয়।”
জমি আন্দোলনের সময়ে ২০০৭-এর ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামের ভাঙাবেড়া ও অধিকারীপাড়ায় পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালিয়েছিল বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেছে সিবিআই। তাতে ১৬৬ জন আন্দোলনকারীর পাশাপাশি ছয় পুলিশ অফিসারের কথাও বলা হয়েছে। সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এ দিন মমতা বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে মামলা ও চার্জশিট, তারা আন্দোলন করেছে। পুলিশের নিচুতলার কয়েক জনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু উপরতলার যারা দাঁড়িয়ে থেকে গুলি চালিয়েছিল, তাদের কী হবে? বুদ্ধবাবুর (তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) নির্দেশে যারা গুলি চালিয়েছিল, তাদেরও দেখতে হবে!”
তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ধারণা, এই মন্তব্যের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী আদতে বিঁধতে চেয়েছেন রাজ্যের তদানীন্তন শাসকদলের নেতৃবৃন্দকেই। এ দিনের সভায় সিবিআই (সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন)-কে ‘কংগ্রেস ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ এবং ‘সিপিএম ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ বলেও কটাক্ষ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “আর ক’দিন আয়ু কেন্দ্রের সরকারের? প্রতিহিংসা করে লাভ নেই!”
নন্দীগ্রামে গুলিচালনার পরের দিনই কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘটনার সিবিআই-তদন্তের নির্দেশ দেয়। রাজ্যের তদানীন্তন বিরোধীনেত্রী মমতাও তখন সিবিআই-তদন্তের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। গত ক’বছর ধরে তদন্ত চালিয়ে গত বছরের গোড়ায় রাজ্য সরকারকে একটি খসড়া চার্জশিট পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। তাতে অভিযুক্ত ছয় পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট পেশের জন্য রাজ্য সরকারের অনুমতি চাওয়া হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তখন জানিয়ে দেয়, তারা রিপোর্টের সঙ্গে সহমত নয়। বরং সিবিআইয়ের কাছে সরকার দাবি তোলে, ওই দিন নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠানোর নির্দেশ ছিল রাজনৈতিক, তাই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবু ও পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের ভূমিকাও তদন্তের আওতায় আনা হোক।
কিন্তু রাজ্য সরকারের বক্তব্য খতিয়ে দেখে সিবিআই জানিয়ে দেয়, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন কোনও তথ্য-প্রমাণ মেলেনি, যার ভিত্তিতে তদন্ত করা যাবে। পাশাপাশি উল্লিখিত ছয় পুলিশ অফিসারের নামে চার্জশিট পেশের জন্য ফের রাজ্য সরকারের অনুমতি চায় তারা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে সিবিআই-কে সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। শেষমেষ সিবিআই গত ডিসেম্বরে নন্দীগ্রাম-মামলা সংক্রান্ত দু’টো আলাদা চার্জশিট আদালতে পেশ করেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করতে না-পারার ব্যাপারটাও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
এবং এ দিন ব্রিগেডের সভায় সিবিআই-চার্জশিটের প্রসঙ্গ তুলেই তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল নেতৃত্ব ও প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য: নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে বুদ্ধবাবু-লক্ষ্মণবাবুর ভূমিকা যাচাই করতে সিবিআই রাজি না-হওয়ায় নিজের ক্ষোভ তিনি গোপন করেননি। প্রসঙ্গত, বুধবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও নন্দীগ্রাম-চার্জশিট প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “সিবিআই-মামলা যে কী হয়, তা ভিখারি পাসোয়ান অন্তর্ধান, ছোট আঙারিয়ার ঘটনা বা নেতাইয়ের গণহত্যা, জ্ঞানেশ্বরী রেল দুর্ঘটনা সব ক্ষেত্রেই চোখের উপরে আছে।” নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনা সম্পর্কে সিবিআইয়ের দেওয়া চার্জশিটকে আক্রমণ করে দলীয় সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, “এই চার্জশিট সিবিআই ও পুলিশ আধিকারিকদের গড়াপেটার খেলা।” চার্জশিট নিয়ে আদালতের দারস্থ হওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
এ দিকে সিবিআই-চার্জশিটের প্রতিবাদে ৩ ফেব্রুয়ারি ‘ধিক্কার দিবস’ পালনের ডাক দিয়েছে নন্দীগ্রামের ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির শরিক এসইউসি। দলের রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসুর অভিযোগ, “সিপিএম নেতৃত্ব ও তৎকালীন রাজ্য সরকারকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েই রিপোর্টটি তৈরি! দেশের সর্বোচ্চ আদালত সিবিআই-কে কেন্দ্রীয় সরকারের তোতাপাখি হিসেবে অভিহিত করেছিল। সেটা ফের প্রমাণিত হল!” জমি আন্দোলনের পর্বে তৃণমূলনেত্রীর আন্দোলনের সঙ্গী ছিল যে পিডিএস, তার রাজ্য সম্পাদক সমীর পূততুণ্ডের মন্তব্য, “নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে কিছু অতিরঞ্জিত প্রচার হয়ে থাকতে পারে। তবে সে সবের পাল্টা কোনও বয়ান তখন পাওয়া যায়নি। বর্তমান সরকারের উচিত, সত্য উদ্ঘাটনের স্বার্থে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্তের অনুমতি দেওয়া।”
কিন্তু তৎকালীন বিরোধী নেত্রী-সহ তৃণমূল নেতারা সে দিন সিবিআই চাইলেও এখন কেন বিরোধিতা করছেন, এ দিন সেই প্রশ্ন তুলেছেন সিপিএম নেতারা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “তৎকালীন বিরোধীরাই সিবিআই-তদন্ত দাবি করেছিলেন। এখন তাঁরাই আবার সিবিআই তদন্তে ভয় পাচ্ছেন!” সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “নন্দীগ্রামে সিবিআই-তদন্ত কি আমরা চেয়েছিলাম? উনি (মমতা) চেয়েছিলেন। আমরা মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের ব্যাপার। যে কারণে আমরা বহু ব্যাপারে সিবিআই-তদন্তে আপত্তি তুলেছি, নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রেও। অথচ বিরোধী থাকাকালীন তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়েও উনি সিবিআই দাবি করতেন!” মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে সেলিমের প্রশ্ন, “উনি তো দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। সিবিআই কী, তখন জানতেন না? এখন কেন সিবিআই-তদন্তে আপত্তি করছেন?”
আদালতে সিবিআইয়ের পেশ করা দু’টি চার্জশিটে বলা হয়েছে: নন্দীগ্রামে ২০০৭-এর ১৪ মার্চ আক্রমণকারী সশস্ত্র জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। সিবিআই তদন্তকারীদের বক্তব্য: ভাঙাবেড়া ও অধিকারীপাড়ায় কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছিল অবৈধ ভাবে। জমায়েতের সামনের সারিতে ছিল মহিলা ও শিশুরা। পিছনে লাঠি-রড-ভোজালি হাতে পুরুষেরা। কয়েক জনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। পুলিশ প্রথমে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। তাতে কাজ না-হওয়ায় গুলি চালাতে পুলিশ বাধ্য হয়েছিল বলে সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। সূর্যবাবুর দাবি: অজস্র শিশুকে পা চিরে খুন, মহিলাদের স্তন কেটে নেওয়া, ট্রলারে চাপিয়ে মৃতদেহ পাচার এমন নানা অভিযোগ তখন বিরোধীদের মুখে শোনা গেলেও সেগুলোর সমর্থনে ন্যূনতম প্রমাণও সিবিআই পায়নি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.