|
|
|
|
মঞ্চ থেকে দিদির ডাক, বেড়া ভেঙে এগিয়ে এসো
ঋজু বসু • কলকাতা |
নবদ্বীপের নিতাই সাহাকে চেপে ধরেছেন রাজারহাটের শেখ কাশেম ও বাগনানের নন্দন ধর। খোঁচা-খোঁচা পাকা দাড়ির বৃদ্ধ তবু হার মানার পাত্র নন। হাসতে হাসতে বোঝাচ্ছেন, নবদ্বীপের মহাপ্রভু তো সবার মনে! ওঁর ছবি না-থাকলেও কী আসে-যায়!
তখনও দিদির আবির্ভাব ঘটেনি। ব্রিগেড মঞ্চের অদূরে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভ্যান রিকশায় বসে জমিয়ে খোশগল্প চলছিল। ‘নবদ্বীপ টিএমসি’-র সৌজন্যেই ভ্যান রিকশায় সাজানো ট্যাবলোয় হাজির বাঙালির প্রিয় মনীষীকুল। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের ছবি না-থাকায় নবদ্বীপের নিতাইবাবুর পা টানতে কসুর করলেন না সদ্য পরিচিত দু’জন। তাতে কী? পাশাপাশি সারি বেঁধে রবীন্দ্র-বিবেকানন্দ-দ্বিজেন্দ্রলাল-নজরুল রয়েছেন। মহাত্মা গাঁধী ও নেতাজির কাটআউটবিশিষ্ট দু’টি ট্যাবলোর গায়ে লেখা, ‘গাঁধীবাদ সুভাষবাদ জিন্দাবাদ’। একই পংক্তিতে সদ্যপ্রয়াত মান্না দে ও সুচিত্রা সেনকেও সচিত্র স্মরণ করা হয়েছে। |
|
ভিড় সামলাতে হিমশিম। বৃহস্পতিবার, ব্রিগেডে। —নিজস্ব চিত্র। |
আমবাঙালির অতীতের বরণীয়দের এ ভাবে এক সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার মতোই মঞ্চে রাজনৈতিক নেতাদের পাশে শিল্প-সংস্কৃতিজগত, টিভি-ফিল্মের তারকাদের উপস্থিতি। আবার মূলস্রোতের পাশে প্রান্তিক কৃষ্টি-পরম্পরাও বাদ পড়েনি। তাই সাংসদ শতাব্দী রায় ও সহশিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনের ঘোষণায় জনতা মঞ্চ বা জায়ান্ট স্ক্রিনে কিছুটা মনোযোগী হলেও মাঠে কয়েক পা অন্তর করম, সোহরাই বা পাতা নাচের আসর ঘিরে জটলা আলগা হয়নি। তৃণমূলের পতাকা হাতে শতাব্দীর নাচের সময়েই একনাগাড়ে ধামসা বাজাতে বাজাতে একটু বিরতি নিলেন আউশগ্রামের দেবসরার মঙ্গল মারডি। তাঁর গায়ে আর্জেন্তিনার জার্সি। বিড়ি ধরিয়ে হেসে বললেন, কেমন মানিয়েছে, বলুন! স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকেই এমন উপহার মিলেছে।
মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলছিলেন, এ বার তৃণমূলের ডাকে শুধু বাংলা নয়, মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কেরল, রাজস্থানের কর্মীরা অবধি কলকাতার ব্রিগেডে হাজির। ভিড়ের মধ্যে বহু দিন বাদে এ শহরের জনসমাবেশে রাজ্যের পাহাড়বাসী ভূমিপুত্রদেরও দেখা মিলল। ভানু তামাং, প্রজল রাই, উপেন গুরুঙ্গরা জোর গলায় বললেন, “ও সব গোর্খাল্যান্ড-ট্যান্ড নিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এখন আমরা উন্নয়নের তাগিদেই মমতাজির পাশে এককাট্টা!”
জঙ্গলমহলের শালবনির পিরাকাটার ৬০-৬৫ জনের দলটির বেশিরভাগই মহিলা। মহাশ্বেতা দেবী যখন পরিবর্তনের পরে জঙ্গলমহলের উন্নয়নের কথা বলছেন, রোদে পিঠ দিয়ে বসে চপ-মুড়ি খেতে খেতে তাঁরা চোখ মেলে চাইলেন। দলটির পাণ্ডা রঞ্জিত মাহাতো, রতিকান্ত মাহাতোরা সগর্বে বলছিলেন, আগে বাম আমলেও তাঁরা কেউ কেউ ব্রিগেডে এসেছেন, কিন্তু জঙ্গলমহল থেকে এত লোক বহুদিন বাদে ব্রিগেডে হাজির।
নন্দীগ্রাম-তদন্ত নিয়ে সিবিআইকে মমতা এক হাত নেওয়ায় খুশি নন্দীগ্রামের শেখ কাহারুল হক, মির মুকতাজ আলিরা। জানান, সাতেঙ্গাবাড়ি ও তিয়াখালির দু’টি বুথ থেকে তিন বাস-বোঝাই লোক এসেছে। |
|
ব্যারিকেড ডিঙোনোর মরিয়া চেষ্টা। ব্রিগেডে সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি। |
ব্রিগেডে আক্ষরিক অর্থেই বাংলার প্রতিটি কোণের উপস্থিতিতে পুরোদস্তুর মেলার মেজাজ। কাপড়ে রঙিন সুতোর নকশা আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির গোসাবার ছোটমোল্লাখালির দিবা সাহা। সমুদ্রগড়ের অরুণ বিশ্বাস ও বনগাঁর শিখা মিস্ত্রিকে দিবাবাবু বুঝিয়ে চলেছেন, আমরা সুন্দরবনের লোক! এক পয়সা বাড়িয়ে বলি না, বুঝলেন! মন্দিরবাজারের সুকুমার নস্কর নিজের হাতে গড়া ক্ষীরের মিষ্টি, মিহিদানা ও গুড়-বাদাম নিয়ে সাতসকালে শিয়ালদহ হয়ে হাজির। বললেন, সাগরমেলার পরে এ বার সরস্বতী পুজোয় সুভাষগ্রামের মেলায় যাব। তার আগে ব্রিগেডের দৌলতে ফাউ ভালই জুটল।
তামাম গ্রাম-বাংলার কলকাতা-দর্শনের দিনে এ বার মাঠের অনেকটা জুড়ে শুধুই বিকিকিনির পসরা। মমতাদির ছবি, জোড়াফুলছাপ চাবির রিং তো তাতে থাকবেই, প্যান্ট-জামা, দুল-হার, ব্যাগপত্তর অবধি ঢালাও বিকোচ্ছে। ছেলেকে পরীক্ষার জন্য আনতে পারেননি ঘাটালের অনিতা অধিকারী। তাই দু’টো জামা কিনে নিয়ে গেলেন। ভুরিভোজের ব্যবস্থাও মন্দ নয়। বেলা পড়তে খিচুড়ির প্লেট ২০ থেকে বেড়ে ৩০ টাকা, এক পিস চিকেন ও ভাতের দাম ৪০ থেকে ৪৫। তবু ঝানু বিক্রেতা জয়নগরের দিলীপ হালদারের হাতছানি কে এড়াবে! নিজেই বলছেন, “ওরেব্বাস, কী বড় পিস মুরগির, এটা আবার বোনলেস!”
উত্সাহের বিচিত্র রং! মেদিনীপুর থেকে আসা মহিলার কোলে একরত্তি শিশু। আলিপুরদুয়ারের মুন্না চন্দ দেবের সঙ্গে হুইলচেয়ারে বন্দি ১০ বছরের মেয়ে। হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতেই মিটিং দেখতে হাজির।
উত্সাহের ঠেলায় মাঝেমধ্যেই বেগ পেয়েছে পুলিশ। ব্যারিকেডের বাঁশে চড়ে জনতাকে বকে-ঝকে সামলাতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার সময়ে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় দেখা গেল মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও ছাত্রনেতা শঙ্কুদেব পণ্ডাকেও। অবশেষে হাল ধরলেন মমতা নিজেই। ঠেলাঠেলির চাপে অঘটন ঘটতে পারে বুঝে নিজেই ব্যারিকেড ভেঙে জনতাকে এগিয়ে আসার অনুমতি দিলেন। দিদি বলছেন, “ছেলেরা একটু দুষ্টু হয়! রবীন্দ্রনাথ তো বলেইছেন, দাও সবে গৃহহারা, লক্ষ্মীছাড়া করে! (পুলিশকে) ব্যারিকেড ভেঙে ওদের এগিয়ে আসতে দিন।”
শুনেই জনতার হো-হো উল্লাস! মিটিংয়ের উত্সবের মেজাজটাই শেষ কথা বলে গেল। |
|
|
|
|
|