মাকড়সার জালের মতো প্রায় অদৃশ্য সুতোয় হাতে বোনা মসলিন বাংলার তাঁতের অহঙ্কার। কিন্তু অতি সূক্ষ্ম মসলিন ব্যবহারের সব থেকে বড় অসুবিধা হল, একবার পরলেই কুঁচকে ভাঁজ হয়ে যায়। দ্রুত ছিঁড়েও যায় মূল্যবান এই কাপড়। বিশ্বজয়ের যাবতীয় উপাদান থাকা সত্ত্বেও তাই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে বাংলার মসলিন। এই সমস্যা থেকে মসলিনকে মুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। নবদ্বীপে শুরু হয়েছে এক বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবির। পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদের উদ্যোগে ওই শিবিরে রাজ্যের পাঁচ জেলার বাছাই করা ২৫ জন তাঁতশিল্পী মসলিন বোনা থেকে উন্নত আধুনিক ডিজাইন বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। পর্ষদের সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকটি সংস্থাও। রাজ্য খাদি বোর্ডের চেয়ারম্যান গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “আমাদের লক্ষ্য, এমন মসলিন তৈরি করা, যা কুঁচকোবে না। রঙিন এবং ডিজাইনার মসলিন তৈরির চেষ্টাও করছি আমরা। সেই সঙ্গে মসলিনের দাম কমিয়ে কী ভাবে বাংলার এই ঐতিহ্যকে আরও বেশি করে মানুষের নাগালের মধ্যে আনা যায়, সে চেষ্টাও করা হচ্ছে।”
|
মসলিনের ক্ষেত্রে যে সূক্ষ্ম সুতো ব্যবহার করা হয়, তা তৈরি করাই বেশ শক্ত। সাধারণ ভাবে প্রতি লাছি সুতোর দৈর্ঘ্য হয় ১০০০ মিটার। মসলিনের সুতো হলে, সেই দৈর্ঘ্যের সুতোর ওজন হবে ২ গ্রাম। তাঁতশিল্পীদের পরিভাষায় যার নাম ৫০০ কাউন্ট। ভাল মসলিনের জন্য অবশ্য আরও সূক্ষ্ম সুতোর প্রয়োজন। মাটিয়ারি কুটীর শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক মুরারি চক্রবর্তী বলেন, “২০১০ সাল থেকে মসলিনের ৪০০ এবং ৫০০ কাউন্টের মসলিন সুতো আমরা নিজেরাই উৎপন্ন করছি। তা দিয়ে এতদিন শুধু মসলিনের সাদা থানই বোনা হত। এই কর্মশালার পর থেকে মসলিনের সম্পর্কে চালু ধারণাটা আমুল বদলে যাবে। রঙিন, ডিজাইনার মসলিন তৈরি করা সম্ভব হবে।” যদিও ৫০০ কাউন্টেই থেমে থাকতে চান না মুরারিবাবুরা। তিনি বলেন, “আমরা ৬০০ কাউন্টের সুতো তৈরির ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি। কিন্তু সমস্যা তুলো নিয়ে। কেবল সুভিন কাপাসের লম্বা আঁশ ছাড়া আর কোনও তুলোয় মসলিন সুতো হয় না। দক্ষিণ ভারতের সালেম একমাত্র জায়গা যেখানে এই তুলো উৎপন্ন হয়।” কর্মশালার অন্যতম উদ্যোক্তা ক্যালকাটা ক্র্যাফট কম্বাইন্ড সোসাইটির চেয়ারপার্সন ঊর্মি পালচৌধুরির বক্তব্য, “আমরা এখন ৪০০ কাউন্টের সুতোয় শুধু রং করতে পারছি তাই নয়, সেই রঙিন সুতোয় সফল ভাবে কাপড় বুনতে পেরেছি। আর এই রঙের দাম প্রতি কেজি সাতশো থেকে দেড় হাজারের মধ্যে। এই রঙের কোন ক্ষতিকর দিকও নেই। তাই আন্তর্জাতিক বাজার উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে নতুন ধারার মসলিনের জন্য।”
প্রশিক্ষণ শিবিরে তাঁতশিল্পীরা প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। ‘কাটনিদের’ হাতে কলমে শেখানো হচ্ছে সেই বিশেষ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সুতো রং করা হচ্ছে স্ট্রাইপ, চেক বা ঝর্না নক্সায়।
বাংলার যে অল্প কিছু কারিগর পুরুষানুক্রমে মসলিন বোনার কাজটি করেন, মসলিনের বাজার কমে যাওয়ায়, তাঁদের পরেই এই ঐতিহ্য থেমে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। উদ্যোক্তারা সব থেকে খুশি এই কথা ভেবে যে, আধুনিক প্রশিক্ষণের ফলে বাজার খুলে গেলে মসলিনের যাত্রা আর থেমে যাবে না। তাঁদের আশা, মসলিন আবার ফিরে পাবে তার পুরনো কদর। |