ব্রিগেড যাত্রা বাতিল করে রক্তাক্ত প্রৌঢ়কে বাঁচালেন দুই যুবক
বাক্স-প্যাঁটরা সমেত ভিড়টা নামিয়ে দিয়ে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যেতেই দেখা গিয়েছিল, প্ল্যাটফর্মের ধুলোয় মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছেন এক প্রৌঢ়। মাথা ফেটে রক্তে ভিজে গিয়েছে তাঁর ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক। সঙ্গের পুঁটলিটা ছিটকে গিয়েছে হাত কয়েক দূরে।
বুধবার সন্ধেয় মুর্শিদাবাদের নিমতিতা স্টেশনে তখন ব্রিগেডমুখী জনতাও ভিড় করেছেন। তাঁদের ঘন ঘন স্লোগান আর স্টেশনের মাইকে ‘ডাউন হাওড়া-মালদহ টাউন প্যাসেঞ্জার’-এর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার অনর্গল ঘোষণানিমতিতা স্টেশন তখন সরগরম। রক্তে ভাসা মানুষটার দিকে ফিরে তাকানোর সময়ই নেই কারও।
সেই ব্যস্ততার মাঝে আহত প্রৌঢ়কে হঠাৎই চোখে পড়ে গিয়েছিল দুই যুবকের। ব্রিগেডের সভায় গ্রামবাসীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য প্ল্যাটফর্ম জুড়ে হাঁকডাক করে এক জায়গায় জড়ো করছিলেন তাঁরা। শাসক দলের নিছকই দুই গ্রামীণ নেতা, সাকির খান আর দেবাশিস চক্রবর্তী। রক্তাক্ত লোকটিকে পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন দু’জনেই। কাছে গিয়েই বুঝেছিলেন মানুষটা সংজ্ঞাহীন, পড়ে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবেন।
আর দেরি করেননি তাঁরা। ছুটে গিয়েছিলেন স্টেশন মাস্টারের ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক রেলকর্মীর কাছে। কিন্তু সাহায্য নয়, তাঁদের অভিযোগ, প্রায় ‘মাছি তাড়ানোর’ মতো ওই রেলকর্মী জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। দেরি না করে আহত লোকটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েছিলেন সাকির। আর দেবাশিস ছুটে ছিলেন ভ্যানরিকশা জোগাড় করতে। তারপর সেই ভ্যানে চাপিয়েই ওই প্রৌঢ়কে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মহেশাইল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

দেবাশিস চক্রবর্তী

সাকির খান
—নিজস্ব চিত্র।
শাসকদলের ওই দুই কর্মীর চেষ্টাতেই শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন মাঝবয়সী ওই ব্যক্তি। ব্রিগেডের সমাবেশ যোগ দিয়ে দলীয় আনুগত্য প্রকাশের চেয়ে আহত মানুষের পাশে দাঁড়ানো জরুরি মনে করেন সাকির ও দেবাশিস। জগতাই ১ ও ২ অঞ্চল কমিটির সভাপতি ওই দুই যুবক বলেন, “একটা লোককে চোখের সামনে মরতে দেখব তা কখনও হয় নাকি!” গ্রামবাসীদের ব্রিগেডে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দলের অন্য নেতাদের সঁপে আহত লোকটির শুশ্রূষা ও পথ্য জোগাড়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা।
মহেশাইল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকেরা অবশ্য ঝুঁকি নেননি। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে আহত প্রৌঢ়কে জঙ্গিপুর হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেন তাঁরা। সাকির বলেন, “এতে সমস্যায় পড়ে যাই আমরা। কাছে তেমন টাকাপয়সা ছিল না। স্থানীয় লোকজনের কাছে শ’দুয়েক টাকা চাঁদা তুলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তা ওষুধ কিনতেই ফুরিয়ে গিয়েছিল।” তাঁদের অনুরোধে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিএমওএইচ অবশ্য অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দেবাশিস বলেন, “জঙ্গিপুর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে যা পয়সাকড়ি ছিল তা দিয়ে ওষুধ কিনে দিলাম। তারপরে আর কী করব, রাতের খাওয়ার মতো কানাকড়িও পড়ে ছিল না। পেটে কিল মেরেই দু’জনে রাত কাটিয়ে দিই হাসপাতালে।” সংজ্ঞাহীন ওই প্রৌঢ়ের পরিচয় অবশ্য রাতেও জানা যায়নি।
তৃণমূলের সুতি ২ ব্লকের সভাপতি মাসুদ রানা ঘটনাটি শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সাকির ও দেবাশিস অত্যন্ত পরোপকারী ছেলে। হাসপাতাল থেকে ওঁরাই ফোন করে আমাকে ঘটনাটি জানিয়েছিল। আমি বলি, ব্রিগেড যাওয়ার থেকে অনেক জরুরি আহত ওই লোকটির পাশে থাকা। এটা বাঁচা-মরার প্রশ্ন। ওঁরা সেটাই করেছেন। দলীয় কর্মী হিসেবে ওঁদের জন্য আমরা গর্বিত।”
এটাই অবশ্য প্রথম নয়। তাঁদের দফাহাট গ্রামে খোঁজ নিয়েও জানা গিয়েছে, পেশায় ওষুধের সামান্য কারবারি সাকির কিংবা নিমতিতায় ছোট্ট একটি প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবরেটরির কর্মী দেবাশিসকে পড়শিরা পরোপকারী হিসেবেই চেনেন। বছর কয়েক আগে ধুলিয়ানের কাছে পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা মা-মেয়েকেও একই ভাবে রাত জেগে বাঁচিয়েছিলেন সাকির। আর গ্রামবাসীদের কথায়, “বিপদে আপদে আর কাউকে না পাই, দেবাশিসদা ঠিক থাকবেন!”
কিন্তু ওই দুই যুবক ব্রিগেড-যাত্রা বাতিল করে রাত জাগলেও রেল কর্তৃপক্ষ দায় এড়াল কেন?
নিমতিতার স্টেশন ম্যানেজার প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, ‘‘মালদহগামী আজিমগঞ্জ-মালদহ প্যাসেঞ্জার নিমতিতা স্টেশনে ঢোকার মুখে ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিলেন ওই প্রৌঢ়। তবে কোনও রেলকর্মী দায় এড়িয়ে থাকলে তা নিন্দনীয়। কী হয়েছিল তা খোঁজ নিয়েও দেখা হচ্ছে। তবে ঘটনাটি জানার পরেই আমি রেল পুলিশের দুই কর্মীকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম।” কিন্তু রেলকর্মীরা এগিয়ে না এলেও স্টেশন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা যাত্রী কিংবা ফেরিওয়ালারা চোখ ফিরিয়ে থাকলেন কেন? প্ল্যাটফর্মের এক চা-স্টলের দোকানি অরুণ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘স্টেশনে তখন খুব ভিড় ছিল। লোকটিকে চোখেই পড়েনি। তবে ওই দুই যুবক এসে চাঁদা চাওয়ায় আমি কিন্তু ফিরিয়ে দিইনি।”
দু-পাঁচ টাকা চাঁদা দিলেও সন্ধের সেই ব্যস্ত নিমতিতা স্টেশন অবশ্য মুখ ফিরিয়েই ছিল। সাকির আর দেবাশিসই সেখানে ব্যতিক্রমী-মুখ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.