প্রবন্ধ...
মেয়েরা কাজ করছেন, মিডিয়া দেখে না
ছেলেরা যদি রজঃক্ষম হত! মাসের ক’দিন কুণ্ঠায় ভরে থাকত না। বরং পৌরুষের সূচনা নিয়ে সগর্বে গলা ফাটাত। সেনাধ্যক্ষ, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মগুরুরা বিবৃতি দিতেন: পুরুষরাই দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে পারে। রজঃস্রাবের রক্তদর্শন নেই, মেয়েরা আক্রমণাত্মক হবে কী ভাবে? পরিসংখ্যানবিদেরা প্রমাণ করতেন, মাসিক রজঃচক্রের সময়েই ছেলেরা বেশি অলিম্পিক পদক জেতে।
সাড়ে চার দশক আগে এ ভাবেই ভারতফেরত এক মার্কিন লেখিকা নিবন্ধ লিখেছিলেন: ইফ মেন কুড মেনস্ট্রুয়েট। সেই সময় তিনি কখনও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, কখনও বা পরিচয় গোপন রেখে শিকাগোর প্লেবয় ক্লাবে তুলোয় তৈরি খরগোসের মতো কান আর তুলতুলে লেজ জুড়ে পানীয় পরিবেশন করছেন। দেখছেন, ধনাঢ্য পরিবেশে কী ভাবে মেয়েদের ব্যবহার করা হয়! তার পরই কলমে চেতাবনি, ‘আফটার ব্ল্যাক পাওয়ার, উইমেন’স লিবারেশন।’ কৃষ্ণাঙ্গরা ক্ষমতা লাভ করার পরের ধাপেই নারীর মুক্তি। মেয়েদের ক্ষমতায়নকে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে গেঁথে দিয়েছেন এই লেখিকা: গ্লোরিয়া স্টাইনেম।
সম্প্রতি জয়পুর ও কলকাতা ঘুরে গেলেন আশি-ছুঁইছুঁই সেই নারী, দুই শহরে দফায় দফায় তাঁর সঙ্গে আড্ডা। এক দিন জিজ্ঞাসাও করে ফেললাম, নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাপারটা ঠিক কী? গ্লোরিয়া হাসলেন, ‘নারী-পুরুষের মধ্যে পুর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য। প্রত্যেকের বেঁচে থাকার সমান অধিকার, সমান কোয়ালিটি অব লাইফ।’ নারীবাদ পুরুষেরও কথা ভাবে? “অবশ্যই। নারী পুরুষ সবাইকে নিয়েই মানুষের সভ্যতা। কিন্তু লিঙ্গ-রাজনীতি তাকে খর্ব করেছে। পৌরুষ মানে কি শুধু মেয়েদের ওপর অত্যাচার? অর্থনৈতিক, সামাজিক ভাবে দুর্বল ছেলেদের ওপরেও ছেলেরা অত্যাচার চালায়।” কিন্তু নারীর স্বাধীনতা? “স্বাধীনতার দিক দিয়ে হয়তো আমরা কিছুটা এগিয়েছি। কিন্তু দুটি স্বাধীন সত্তা একে অপরকে বাদ দিয়ে থাকতে পারে না, প্রয়োজন যথার্থ পরস্পরনির্ভরতা। ইন্ডিপেন্ডেন্সই শেষ নয়, ভাবতে হবে ইন্টারডিপেন্ডেন্সও।”
পরস্পরনির্ভরতার প্রতীতি তাঁর লেখাতেও: পরিবারে মেয়েকে ছেলের মতো বড় করতে হবে, সমাজে ছেলেকে মেয়ের মতো বাড়তে দিতে হবে। এই সব লেখা পড়ার পর মনে হয়, টিভির পর্দায় যে রাজপুত্তুররা ভোটের খাতিরে বাহান্ন বার ‘উইমেন’স এমপাওয়ারমেন্ট’ আওড়ান, তাঁদের সঙ্গে গ্লোরিয়ার বিস্তর তফাত।
ভারতীয় রাজনীতি গ্লোরিয়ার কাছে অচেনা মহাদেশ নয়। পঞ্চাশের দশকে এ দেশে পড়তে এসে বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সঙ্গীদের নিয়ে জাতিদাঙ্গাধ্বস্ত তামিলনাড়ুর গ্রামে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন, বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সদ্য-স্বাধীন ভারত সে দিন ২২ বছরের মার্কিন ছাত্রীকে আদৌ কিছু শিখিয়েছিল? “অবশ্যই। আজও ভুলতে পারি না, দাঙ্গাধ্বস্ত গ্রামে মুখিয়ারা লোকদের বোঝাচ্ছেন, হামলাকারীদের ওপর প্রতিশোধ না নিয়ে শান্ত থাকতে হবে। আমি শিখলাম, আন্দোলন ওপর তলা থেকে নয়, নীচ থেকে তৈরি হয়। গাঁধীজির কথা তাই আজও ভরসা জোগায়। তুমি মানুষের জন্য করলে মানুষও তোমার কথা ভাববে।”
পঞ্চাশের দশকেই থমকে থাকেনি তাঁর ভারত-সংযোগ। গত কয়েক বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘আপনে আপ’-এর সঙ্গে যুক্ত। নারী পাচার রোধে কাজ করে এই সংস্থা। ভারতীয় নারীর হাল-হকিকত গ্লোরিয়ার অজানা নয়। ধর্ষণ কি বাড়ছে? বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে? “বলতে পারব না। ধর্ষণ বাড়ছে, না মিডিয়ার সচেতনতায় ঘটনাগুলি প্রকাশ্যে আসছে, পরিসংখ্যান ছাড়া বলা দুষ্কর।” জয়পুরের ডিগ্গি প্রাসাদে এই আড্ডার একটু আগে অমর্ত্য সেন অবশ্য ধর্ষণের পরিসংখ্যান শুনিয়ে গিয়েছেন। ভারতে ধর্ষণের ঘটনা তুলনায় কম। এক লক্ষে ১.৮। আমেরিকায় সংখ্যাটি ২৭, ব্রিটেনে ২৯।
পরিসংখ্যান কম হলেই নিশ্চিন্ত থাকা যায় না, অমর্ত্য সেনও সে-কথা প্রবল ভাবে মানবেন। কথায় কথায় এল লাভপুর, সাঁওতাল গ্রামে গণধর্ষণের শাস্তি। খবরটি গ্লোরিয়ার চোখ এড়ায়নি, “মহামারির অনুপ্রবেশ। সব ট্রাইবাল সমাজের বৈশিষ্ট্য: নারী-পুরুষ ক্ষমতার সাম্য। নেটিভ আমেরিকানদের দেখে অবাক হয়ে ইউরোপিয়ানরা চিঠি লিখতেন, অদ্ভুত জীব! মেয়ে বন্দিদেরও ধর্ষণ করে না।”
মহামারি এল কোথা থেকে? সেখানেই গ্লোরিয়া স্টাইনেমের তত্ত্ব: পুরুষ নারীকে শুধুই প্রজননের জরায়ু-যন্ত্র হিসেবে দেখেছে। পুরুষতন্ত্র মানে সেই প্রজনন-যন্ত্রের ওপর প্রভুত্বের ইচ্ছা। “আপনার এবং আমার দেশে এক দল লোক আছে, যারা যৌনতার মুখ্য উদ্দেশ্য বলতে শুধু সন্তান উৎপাদন ভাবে। ছকে মেলে না বলেই এরা মেয়েদের স্বাধীনতা, গর্ভপাত, সমকামী আন্দোলন, সব কিছুর বিপক্ষে।” গত কয়েক দশক ধরে সাঁওতাল গ্রামে সালিশি সভা, টিভি, মোবাইল ফোন এবং দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশের আড়ালে তবে কি প্রজনন-নির্ভর যৌনতার দৃষ্টিভঙ্গিও ঢুকে গিয়েছে?
কিন্তু নারী আন্দোলনের বাইরেও তৃতীয় বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের পিছনে রয়েছে আরও অনেক কারণ। জঁ দ্রেজ-অমর্ত্য সেনের ‘ইন্ডিয়া: অ্যান আনসাটর্ন গ্লোরি’ গ্রন্থে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ, পোশাক শিল্প ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখকরা। ওই তিনের কারণে বাংলাদেশের গ্রামে মায়েদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটছে, প্রসূতির মৃত্যুহার কমছে। এ ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের ভূমিকা নেই? “অবশ্যই আছে। সেনের সঙ্গে আমি একমত। ভারত চাইলে বাংলাদেশের মডেল নিতেই পারে। এখানে নিশ্চয় কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা এই জাতীয় প্রকল্পে মেয়েদের পুকুর কাটা, জল পরিষ্কার রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু শৌচাগার? অন্য স্বাস্থ্যবিধি? ভারতে মেয়েদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার আর ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের আধিক্য। গ্রাম বা ব্লকস্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছে গরিব মেয়েদের সেই চিকিৎসার উপকরণ?”
নারী আন্দোলনের আরও একটা দিক নিয়ে কথা হল। বছর দেড়েক আগে নির্ভয়া কাণ্ডের পর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সমালোচনা ছিল, মেট্রো শহরে ধর্ষণ হলে নাগরিক সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাশ্মীর, মণিপুরের ক্ষেত্রে চুপ করে থাকে। “মানতে পারলাম না। নারী-আন্দোলনের একটা ছোট্ট অংশ মেট্রো শহরে। আমি নিজে ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন’-এর (সেবা) কথা জানি। ভারতে সবচেয়ে বড় মহিলা ইউনিয়ন। প্রায় উনিশ লক্ষ সদস্য। বেশির ভাগই তামাক পাতা বাঁধা বা ইটভাটায় কাজের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। জানি ‘আপনে আপ’কে। সোনাগাছি, ওয়াটগঞ্জে কাজ করে। নারী আন্দোলনের বড় অংশটা কিন্তু গ্রামগঞ্জে, নিচুতলায় কাজ করে। মিডিয়ায় তাদের দেখা যায় না। নারী আন্দোলন মানে শুধু ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে মিছিল নয়।” আপনি তা হলে ধর্ষণকারীদের ফাঁসি চান না? গ্লোরিয়া এ বার তীক্ষ্ণ হলেন, “আমি কোনও রাষ্ট্রকেই খুনির ভূমিকায় দেখতে চাই না।”
কলকাতার সোনাগাছি, ওয়াটগঞ্জ এলাকাতেও ঘটেছে গ্লোরিয়া-সফর। শুনলাম, সেক্স ওয়ার্কার বা যৌনকর্মী শব্দটি তাঁর পছন্দ নয়। “এঁরা কেউই স্বেচ্ছায় নয়, দায়ে পড়ে শ্রম বিক্রি করেন। বেশির ভাগই পাচার হয়ে-আসা মেয়ে, শ্রমিকের অধিকার নেই। ফলে শব্দটি অসহ্য।” সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীও এক নিবন্ধে ওই শব্দটি নিয়ে বেশ হাসিঠাট্টা করেছিলেন। গ্লোরিয়া আর একটু এগিয়ে গেলেন, “প্রস্টিটিউটেড উওম্যান লিখলে কেমন হয়? যে প্রস্টিটিউশনের মধ্যে এসে পড়েছে।” এই শব্দের বাংলা সম্ভব? পরে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ঘেঁটে চমকে উঠেছিলাম। সংস্কৃত থেকে আসা মূল তৎসম শব্দটি আদৌ স্ত্রীলিঙ্গবাচক নয়: বেশ্য। গ্লোরিয়ার ইঙ্গিত, বাংলা ভাষাতেও আনতে পারে নতুন শব্দ। যৌনকর্মীকে বিসর্জন দিয়ে বেশ্যিত নারী/পুরুষ বললে কেমন হয়?
কথা উঠল বিল গেট্স ফাউন্ডেশন নিয়েও। গ্লোরিয়া বিরক্ত। ওই সংস্থা তাঁর চোখে স্রেফ কন্ডোম বিতরণ যন্ত্র। “ওরা যৌনপল্লীর অসহায় মেয়েদের চেয়েও বেশি ভাবে রোগের হাত থেকে পুরুষকে বাঁচানোর কথা। ফলে ক্ষমতা কিন্তু বাড়িউলি মাসি, দালাল আর পাচারকারীদের হাতেই রয়ে গিয়েছে। মেয়েদের কোনও চয়েস নেই, বরং খরিদ্দার বেশি টাকা দিলে দালালেরা তাদের কন্ডোম ছাড়া শুতে বাধ্য করছে।”
পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা-র সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল, গেট্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অস্ট্রেলিয়ায় নতুন জেনেটিক ভ্যারাইটির কলা চাষ। লোহায় সমৃদ্ধ কলা, খেলে ভারতীয় নারীদের রক্তাল্পতা দূর হবে। “ভারতে প্রায় আড়াইশো রকম কলাগাছ আছে। সব বানচাল করে জিন-পরিবর্তিত ওই কলা চাষে বিপদ সাঙ্ঘাতিক। এখানকার দেশজ প্রজাতিগুলি নষ্ট হয়ে যাবে,” বোঝাচ্ছিলেন তিনি।
এখানেই তাঁর সমসাময়িক নারীবাদের অন্য প্রবক্তাদের থেকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায় তাঁকে। “আগে মুক্ত নারীর সংজ্ঞা ছিল অন্য। যে বিয়ের আগে সহবাস করে, বিয়ের পরে চাকরি করে। আর এখন মুক্তি মানে আর একটু বেশি। মার্কিন মূল্যবোধের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে স্বাধীন থাকা।” হাসলেন গ্লোরিয়া।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.