প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ লইয়া কুনাট্যের জল সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়াইল। অভিযোগ, রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই পরীক্ষার ফলাফলে প্রভূত কারচুপি করিয়াছেন। অভিযোগের সত্যাসত্য তদন্ত ও বিচারের পরে জানা যাইবে। কিন্তু, টেট নামক পরীক্ষাটি আদৌ কেন থাকিবে, সর্বাগ্রে এই প্রশ্নটি করা প্রয়োজন। রাজ্যব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটিই পরীক্ষা লইতে হইবে, ইহা এক অর্থহীন অভ্যাসকে বিনা প্রশ্নে বহিয়া চলা ভিন্ন আর কিছু নহে। কেন্দ্রিকতার অভ্যাস। এই অভ্যাসটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই সীমিত নহে, তাহা সর্বব্যাপী। স্কুলশিক্ষকতা হইতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, করণিক হইতে সর্বোচ্চ আমলার চাকুরি, সর্ব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নাকি অপরিহার্য। জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স গোত্রের পরীক্ষাগুলিও এই একই অভ্যাসের ঐতিহ্য বহিয়া চলিতেছে। কেন, সেই প্রশ্নের সদুত্তরের আশা নাই। কারণ, এই অভ্যাস যুক্তিহীন। ভারতে আর পাঁচটি ক্ষেত্রে যেমন পুরাতন নিয়মগুলি মানিয়া চলাই দস্তুর, এই ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়াছে। ফারাক এইটুকুই যে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ এই অবান্তর অভ্যাসের ফাঁসে আটকা পড়িয়া আছে।
প্রাথমিক স্কুল হইতে বিশ্ববিদ্যালয়, কোনও প্রতিষ্ঠানই অভিভাবকহীন নহে। কোনও এক জন প্রার্থী শিক্ষকতার যোগ্য কি না, তাহা বিচার করিবার সামর্থ্য প্রাথমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আছে বলিয়াই আশা করা চলে। না থাকিলে, কোনও যোগ্যতর ব্যক্তিকে সেই গুরু পদে নিয়োগ করাই শ্রেয়। মোট কথা, শিক্ষক নিয়োগের কাজটি প্রতিষ্ঠানেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। সরকারি কলেজের শিক্ষক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিযুক্ত হইবেন বা প্রাথমিক স্কুলে পড়াইতে হইলে টেট নামক বিশৃঙ্খলা অতিক্রম করিয়া আসিতে হইবে, এমন ব্যবস্থা অবিলম্বে পরিহার্য। কুযুক্তির অবশ্য অভাব নাই। সরকার বলিতে পারে, যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পূর্ণত বা আংশিক ভাবে সরকারের অর্থে চলে, অতএব নিয়ন্ত্রণের রাশ হাতে রাখিবার অধিকার সরকারের আছে। কর্তারা স্মরণে রাখিবেন, সরকারের টাকা বলিয়া কিছু নাই। তাহা জনগণের অর্থ, সরকার অছিমাত্র। টাকার জোরে নিয়ন্ত্রণ করিবার অধিকার সরকারের নাই।
ঢালাও পরীক্ষা বন্ধ করিয়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের হাতে নিজস্ব নিয়োগের অধিকার তুলিয়া দিলে তাহাতে দুর্নীতি বাড়িবে, এই আশঙ্কাটি নূতন নহে। আশঙ্কাটি যে অমূলক, পশ্চিমবঙ্গে তেমন দাবি করিবারও কোনও উপায় নাই। কিন্তু, টেট-এর বিরুদ্ধে যে পরিমাণ দুর্নীতির অভিযোগ এই দফাতেই উঠিয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট, রাজ্যব্যাপী পরীক্ষা দুর্নীতি ঠেকাইবার অস্ত্র নহে। বস্তুত, যে কোনও কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাই দুর্নীতির প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র, কারণ বৃহৎ ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাঠামো, আমলা, কর্মীদের উপর নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। এবং, দুর্নীতির প্রধান আকর রাজনীতিকরা প্রশাসনের উপর বিপুল আধিপত্য বিস্তার করিতে অভ্যস্ত এবং সমর্থ। ফলে, কেন্দ্রীয় পরীক্ষা প্রকৃতার্থে দুর্নীতির সিংহদুয়ার। তাহা বন্ধ করিয়া প্রতিষ্ঠানের হাতে নিয়োগের দায়িত্ব দিলে দুর্নীতির অনেকগুলি খিড়কির দরজা খুলিবে বটে, কিন্তু সদিচ্ছা থাকিলে তাহা নিয়ন্ত্রণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হইবে। স্থানীয় স্তরে কে দুর্নীতির বেসাতি করিতেছেন, তাহা নির্দেশ করা সহজতর। চাহিলে রাজ্য প্রশাসন তাঁহাদের নিয়ন্ত্রণ করিবেন। টেট-এর ন্যায় পরীক্ষা আর একটি বারও হওয়া উচিত নহে। পরিবর্তন প্রয়োজন। অবিলম্বে। |