জলপাইগুড়ির বজরাপাড়া বিস্ফোরণ-কাণ্ডে অভিযুক্ত কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও)-এর দুই জঙ্গি ধরা পড়ল বুধবার। গ্রেফতার করা হয়েছে এক ফুচকা বিক্রেতাকেও। এই তিন জনের গ্রেফতারে এক মাস আগের ওই বিস্ফোরণ কাণ্ডের জট অনেকটাই কেটে গেল বলে পুলিশের দাবি। বুধবার শিলিগুড়ি মহকুমার নেপাল সীমান্তবর্তী অধিকারী এলাকা থেকে ওই তিন জনকে গ্রেফতার
করে পুলিশের স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি)।
পুলিশ জানায়, ধৃতরা হল কেএলও-র ডেপুটি কম্যান্ডার-ইন-চিফ নারায়ণ রায় ওরফে তরুণ থাপা, সহকারী সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় ওরফে ইকবাল সিদ্দিকি ওরফে প্রাণনারায়ণ কোচ। তৃতীয় জন ফুচকা বিক্রেতা। নাম রামশঙ্কর বসাক। তিনি জলপাইগুড়ির ভক্তিনগর থানার টাকিমারি চরের বাসিন্দা। রামশঙ্কর জলপাইগুড়িতে বিস্ফোরক পৌঁছতে মদত দিয়েছিলেন বলে পুলিশের দাবি। এই নিয়ে বজরাপাড়া বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হল। আজ, বৃহস্পতিবার ধৃতদের শিলিগুড়ি আদালতে তোলা হবে।
উত্তরবঙ্গের আইজি জাভেদ শামিম এ দিন শিলিগুড়িতে বলেন, “ধৃত ৩ জন জলপাইগুড়ির বিস্ফোরণে সরাসরি যুক্ত ছিল বলে স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।” পুলিশের এক কর্তা জানান, প্রাথমিক ভাবে ধৃতদের কাছ থেকে যা তথ্য মিলেছে তাতে স্পষ্ট, জলপাইগুড়ি শহরে নজরদারি বেশি থাকায় অপেক্ষাকৃত অরক্ষিত বজরাপাড়াতেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর ছক কষেছিল কেএলও। |
গত বছর ২৬ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ জলপাইগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে বজরাপাড়ায় একটি সেতুর উপরে টিফিন বাক্সে রাখা শক্তিশালী বোমা ফেটে ছ’জনের মৃত্যু হয়। জখম হন ৩ জন। কেএলও ঘটনার দায় অস্বীকার করে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে পুলিশকে দোষারোপ করে। কিন্তু পুলিশ যে সব তথ্যপ্রমাণ পায়, তাতে কেএলও-র দিকেই সন্দেহের তির যায়। পুলিশ প্রথমে সন্দেহভাজন কেএলও জঙ্গি তরুণ থাপার বোন এবং ভগ্নীপতি সন্তোষকে গ্রেফতার করে। তার পর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে প্রাক্তন কেএলও সদস্য তথা আত্মসমর্পণকারী চন্দন রায়-সহ মোট ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানতে পারে, তরুণ ও ইকবাল জলপাইগুড়ি জেলায় নাশকতা ঘটিয়ে হুমকি দিয়ে টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছে। তখনই দু’জনকে গ্রেফতারের জন্য লাগাতার নজরদারিতে নামে এসওজি।
পুলিশের দাবি, এ দিন নেপাল সীমান্ত থেকে খড়িবাড়ির ওই গ্রামে ঢুকে আত্মগোপন করেছিল তরুণ ও ইকবাল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে তল্লাশি চালায়। ওই দু’জনকে গ্রেফতারের সূত্রেই গ্রামেরই অন্য একটি বাড়ি থেকে লিঙ্কম্যান রামশঙ্করকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ সূত্রের দাবি, ধৃতদের জেরা করে বিস্ফোরকের উৎস ও উদ্দেশ্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। জানা গিয়েছে, অসমে কেএলও-র শীর্ষ নেতা লাল সিংহ ডেকা একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক সংগ্রহ করেন। অসমে গিয়ে সেই বিস্ফোরক একটি টিফিন কৌটোয় ভরা হয়। তরুণ থাপা ও ইকবাল অসমে গিয়ে ওই বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি বোমা পলিথিন ব্যাগে ভরে মোটরবাইকে ধুবুরি হয়ে উত্তরবঙ্গে ঢোকে। ডুয়ার্সে ঢোকার পরে ফুচকাবিক্রেতা রামশঙ্করের সাহায্য নেওয়া হয়। ময়নাগুড়ি রোড এলাকায় তিস্তা নদীর পাশের একটি গ্রামে গত ২৫ ডিসেম্বর বিকেল থেকেই বোমাটি লুকিয়ে রাখা হয় বলে পুলিশের সন্দেহ।
গত ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঘন কুয়াশার সুযোগ নিয়ে বোমা নিয়ে তরুণ, ইকবাল ও রামশঙ্কর একটি মোটরবাইকে বজরাপাড়ার সেতুতে পৌঁছয়। সেখানে পলিথিনের ব্যাগে বিস্ফোরক বোঝাই টিফিন কৌটো রেখে টাইমার সেট করে তারা সরে পড়ে। পুলিশের দাবি, জেরায় ধৃতরা জানিয়েছে ২০ মিনিট পরে ওই বিস্ফোরণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা ব্যাগ রাখার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এলাকার এক বাসিন্দা ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটোটি বার করে সেটি খোলার চেষ্টা করায় আগেই বিস্ফোরণ হয়। পুলিশের দাবি, ধৃতরা পালানোর পথে সেই শব্দও পেয়েছিল বলে জেরায় জানিয়েছে। এর পর তারা দ্রুত ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তরুণ
ও ইকবাল মোটরবাইকে নেপালের দিকে যায়। রামশঙ্কর বাসে শিলিগুড়ি চলে যায় বলে পুলিশের অনুমান। আদতে জলপাইগুড়ির মান্তাদাড়ি এলাকার টাকিমারির বাসিন্দা হলেও সে প্রায় দেড় দশক ধরে একটি প্রতিবেশী দেশে ব্যবসা করত। তবে তার শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এলাকায় ‘ফুচকা-শঙ্কর’ নামে পরিচিত ওই ব্যক্তির মোবাইল ফোন থেকে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসাজশের স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে বলে পুলিশের দাবি।
ধৃত তরুণ থাপা জলপাইগুড়ির বেলাকোবার মন্থনি এলাকার বাসিন্দা। ২০০২ সালে কেএলও-র চতুর্থ ব্যাচে ভুটানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল সে। তরুণের সঙ্গেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল ময়নাগুড়ি রোড এলাকার বাসিন্দা প্রদীপ ওরফে ইকবালও। দু’জনেই ২০০৩-এ ভুটানে সেনা অভিযানের সময় ধরা পড়েছিল। ২০১০ সালে জামিনে মুক্তি পায় প্রদীপ। পরের বছর কেএলও-র অন্যতম শীর্ষ নেতা টম অধিকারীর সঙ্গেই জেল থেকে ছাড়া পায় তরুণ থাপা। ২০১১ সালে আত্মসমর্পণকারী কেএলও-রা আলোচনা চেয়ে কমিটি তৈরি করে। সেই কমিটির মুখপাত্রও ছিল ইকবাল। তরুণ চা পাতার ব্যবসা করত বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। ভুটানে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ইকবালের সঙ্গে পরে কেএলও-র চিফ জীবন সিংহের ঘনিষ্ঠতা হয়।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ফেরার হওয়ার পরে একটি প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র এনে মজুত করার দায়িত্ব ছিল ইকবালের।
|