বৃহস্পতিবার ভরসন্ধ্যায় প্রবল বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল জলপাইগুড়ির পাহাড়পুর-বজরাপাড়ার একটি ছোট সেতু। যে ঘটনায় প্রাণ হারালেন পাঁচ জন। আহত আরও চার। প্রাথমিক তদন্তের পরে রাজ্যের পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্তাদের অনুমান, এই নাশকতার পিছনে হাত রয়েছে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা কেএলও-র। এমনকী, তাঁরা মনে করছেন, নিহতদের মধ্যেই এক জন সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বিস্ফোরক।
ঘটনাটি ঘটে সন্ধ্যা সাতটা কুড়িতে। আর এ দিনই বিকেল সাড়ে চারটের সময় উত্তরবঙ্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নবান্নে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিক ও গোয়েন্দা কর্তাদের সতর্ক করে মুখ্যমন্ত্রী ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটোসাটো করতে বলেন। রাতে এই ঘটনার পরে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, পড়শি রাজ্য থেকে জঙ্গিদের মদত এসে থাকতে পারে। কোনও ভাবেই এদের বরদাস্ত করা হবে না। কড়া হাতে পরিস্থিতি দমন করা হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিনের বিস্ফোরণে নিহতেরা হলেন রসিদুল ইসলাম (২০), আর্নেস হোসেন (২০), পাপ্পু রহমান (২৩), অঞ্জন রায় (২৫) এবং লালমোহন দেবনাথ (৪২)। রসিদুল দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। পাপ্পু অ্যাম্বুল্যান্স চালান। তদন্তের ভার যাঁর উপরে রয়েছে, প্রাথমিক তদন্তের পরে সেই আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা জানিয়েছেন, লালমোহন দেবনাথ কেএলও লিঙ্কম্যান। তিনি সাইকেলে বিস্ফোরক বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে পেশায় কসাই লালমোহনের দেহও। |
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ? সে ক্ষেত্রে হঠাৎ পাহাড়পুর-বজরাপাড়ার সেতুটিকেই কেন বেছে নিল কেএলও? সন্ধ্যায় সেতুটির আশেপাশে বেশ ভিড় থাকে ঠিকই, কিন্তু উত্তরবঙ্গে এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে বিস্ফোরণ হলে এর থেকে অনেক বেশি হতাহতের আশঙ্কা ছিল।
প্রশাসন সূত্রে বলা হয়, ওই সেতুর উপরেই বিস্ফোরণ ঘটানোর ছক ছিল, নাকি তা বয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রাথমিক তদন্ত এবং এলাকা পরিদর্শনের পরে পুলিশ তথা গোয়েন্দা সূত্রের অনুমান, বিস্ফোরকটিতে টাইমার লাগানো ছিল। সম্ভবত সময় বেঁধে রাখা হয়েছিল তাতে। উদ্দেশ্য ছিল, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কোথাও বিস্ফোরণ ঘটানো। হয়তো টাইমারের গোলমালে সেতুর উপরেই বোমাটি ফেটে যায়। গোয়েন্দা সূত্রে আরও বলা হয়েছে, সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল কোনও এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই ঘটনায় বাকি যে চার জন প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আজ, শুক্রবার জলপাইগুড়ি যাচ্ছেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। ঘটনা খতিয়ে দেখতে যাওয়ার কথা রয়েছে সিআইডি-র কর্তাদেরও।
প্রাথমিক তদন্তে কেএলও-র নাম উঠে আসার পরে গোয়েন্দা সূত্রে বলা হচ্ছে, এ দিনের ঘটনার পরে মনে হচ্ছে, কেএলও তাদের অপারেশনের ধরন বদলে ফেলেছে। এর আগে তারা গুলি চালিয়ে নাশকতাই বেশি করত। তখন তাদের প্রতি রাজবংশী মানুষের প্রবল সমর্থন ছিল। সেই সমর্থন এখন অনেকটাই কমেছে। সম্ভবত সে কারণেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক তৈরির পথ নিতে চাইছে তারা। গোয়েন্দা সূত্রের বক্তব্য, এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, এখন পর্যটন ও চা শিল্পের রমরমার ফলে আবার টাকা আসতে শুরু করেছে উত্তরবঙ্গে। এই সময়ে আতঙ্ক তৈরি করতে পারলে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অস্থির করে তোলা যাবে। ফলে উত্তরপূর্বের অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি এই এলাকা ব্যবহার করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, জনভিত্তি কমে যাওয়ায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার পথ দরকার ছিল কেএলও-র। এমন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটাও করা সম্ভব।
সব দিক থেকে খতিয়ে দেখে গোয়েন্দারা তাই এ দিনের ঘটনাকে কেএলও-র দ্বিতীয় ইনিংসের জোরালো সূচনা বলেই মনে করছেন। যেখানে সাইকেলে বিস্ফোরক নিয়ে নাশকতায় বেরোচ্ছে তাদের সদস্যরা। এর সঙ্গে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের অপারেশনের মিলও পাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
পুলিশ সূত্রে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি একই কায়দায় আলিপুরদুয়ারের চৌপথি এলাকায় বিস্ফোরক রেখেছিল জঙ্গিরা। যা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে এক পুলিশকর্মী মারা যান। বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ছিল কেএলও-র শহিদ দিবস। আগামিকাল, ২৮ ডিসেম্বর কেএলও-র প্রতিষ্ঠা দিবস। এই দু’দিনে কেএলও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে উত্তরবঙ্গের যে কোনও প্রান্তে নাশকতা ঘটাতে পারে বলে পুলিশ এবং গোয়েন্দারা আশঙ্কাও করছিলেন। দিন সাতেক আগেই কলকাতার রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা দফতর থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন থানায় এই সম্পর্কে সতর্কবার্তাও পাঠানো হয়েছিল। এমনকী, মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে বুধবার সন্ধ্যায় কেএলও-র লিঙ্কম্যান সন্দেহে তিন জনকে জলপাইগুড়ির বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতারও করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত আদিত্য রায় মান্তাদড়ি, পবিত্র রায় এবং অনুকূল রায় ময়নাগুড়ির বাসিন্দা। ধৃতেরা মূলত কেএলও-র হয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা শুরু করেছিল বলে পুলিশের অভিযোগ। তা সত্ত্বেও এ দিনের বিস্ফোরণ রোখা যায়নি। এ দিন যে বিস্ফোরণটি ঘটে, তার সঙ্গে ২০০৬-এর নভেম্বরে বেলাকোবা স্টেশনে নিউ জলপাইগুড়ি-হলদিবাড়ি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে বিস্ফোরণের যথেষ্ট মিল রয়েছে। সেই ঘটনায় মারা যান ৭ জন। সেখানেও অভিযুক্ত ছিল কেএলও।
কী ঘটেছিল এ দিন সন্ধ্যায়?
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা সাতটা কুড়ি নাগাদ কানফাটা আওয়াজে কেঁপে ওঠে ডুয়ার্স থেকে জলপাইগুড়ি শহরে ঢোকার এই সেতুটি। প্রথমে আগুনের ঝলকানি, পরে ধোঁয়ায় ঢেকে যায় এলাকা। ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা যায়, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন জনা দশেক। ঘটনাস্থলেই তিন জনের মারা যান। গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় আরও দু’জনের। |