|
|
|
|
একসঙ্গেই মৃত্যু তিন বন্ধুর
রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় • জলপাইগুড়ি |
অন্য সন্ধ্যার মতই বৃহস্পতিবার, অন্ধকারে ঢাকা করলা নদীর শাখা ধরধরা নদীর ছোট্ট সেতুটির উপর বাসিন্দারা ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। পাশের, একটি মুদি দোকানের সামনে ঝুলে থাকা পথবাতির হালকা আলো সেতুর রেলিং-এ এসে পড়েছে। সেতুতে আলো বলতে অতটুকুই। সেতুর একদিকে জলপাইগুড়ি শহর। অন্যদিকে ৩১-ডি জাতীয় সড়ক। মাঝে একফালি এলাকাটি অন্ধকারে ঢাকা। স্থানীয় বিডিও অফিসের সামনের একটি দোকান থেকে তেলেভাজা খেয়ে মোটরবাইকে চেপে ফিরছিলেন তিন বন্ধু।
স্থানীয় একটি স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রসুদুল, মাধ্যমিক পাশ করা আর্নেস এবং অ্যাম্বুলেন্স চালক পাপ্পু। পাপ্পুই বাইক চালাচ্ছিলেন। বজরাপাড়ার সেতু পার হয়ে ঢাল ধরার মুখেই প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা এলাকা। সঙ্গে আগুনের ঝলকানি। গোটা এলাকা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল কয়েক মুহূর্ত। কিছু পরে টর্চ, মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা এসে দেখেন তিন বন্ধুর দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পাপ্পুর খুড়তুতো দাদা মহম্মদ আলি বললেন, “ছেলেগুলো পুড়ে গেল। বাইকটা অক্ষত-ই ছিল। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে বলে পাপ্পু বাড়ি থেকে বার হয়। তখনও জানি না যে ও আর কোনও দিনও ফিরবে না।” |
|
আহতদের আনা হয়েছে জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে।
বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন সন্দীপ পাল। |
অন্যদিনের মতোই দিনভর জলপাইগুড়ি শহরে রিকশা চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন বজরাপাড়ার বাসিন্দা মাধব রায়। সেতুতে ওঠার মুখেই হঠাৎই তীব্র বিস্ফোরণে তাঁর হাত থেকে রিকশার হ্যান্ডেল ফস্কে যায়। রিকশা-সহ তিনি উল্টে পড়েন। আহত না হলেও, ঘটনার ঘণ্টাখানেক পরেও তার মুখে আতঙ্কের ছাপ। সেতুর উপরে তখনও পড়ে রয়েছে ছিন্নভিন্ন তিনটি দেহ। পাশে দাঁড়িয়েই তিনি বললেন, “রিকশা নিয়ে সবে সেতুতে উঠব। হঠাৎই দেখি সামনে আগুনের ঝলকানি। সঙ্গে বিকট শব্দ। চমকে উঠে রিকশা থেকে পড়ে যাই। তারপরে আর পেছন ফিরে তাকাইনি, দৌড়ে পালাতে শুরু করি।”
বিস্ফোরণের সময় সেতুতেই ছিল দশম শ্রেণির ছাত্রী সায়ন্তিকা সাহা। পাহাড়পুরের বাসিন্দা সায়ন্তিকা মায়ের সঙ্গে টিউশন থেকে ফিরছিল। সায়ন্তিকার পায়ে সসপ্লিন্টার উড়ে এসে লেগেছে। বিস্ফোরণে আক্রান্তদের জন্য জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে তড়িঘড়ি তৈরি করা পৃথক ইউনিটের। চিকিৎসাধীন সায়ন্তিকার সঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি দেখা করেন। পুলিশ সুপারকে সায়ন্তিকা বলে, “মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎই পাশ দিয়ে একটা বাইক চলে গেল। বাইকটা সেতুর ও পারে পৌঁছোনোর সময়ই হঠাৎই বিকট শব্দে কেঁপে উঠল সেতুটা। আগুনের ঝলকানিতে চোখ বন্ধ হয়ে গেল, গায়ে একটা খুব গরম হলকা এসে লাগল। আর পাঁয়ে যেন প্রচণ্ড জোরে কী একটা এসে বিঁধল। সঙ্গে সঙ্গে উল্টে পড়ি। তারপরে চোখ খুলে দেখি হাসপাতালে রয়েছি।” |
|
বাঁ দিকে শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা
হয়েছে আহতদের।
ডান দিকে শোকার্ত পরিজনেরা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
সেতুর পাশে একটি মুদি দোকানে ডিম কিনতে এসেছিলেন এলাকারই বাসিন্দা মহম্মদ রাজা। তাঁর কথায়, “সবে ডিমের দাম দিতে যাব। তারপরে ভেবেছিলাম সেতুতে গিয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরব। তখন সেই কানফাটা শব্দ। মাথায় জোরে আগাত খেয়ে পড়ে গেলাম। এই টুকুই মনে আছে।” এ দিন ঘটনার পরেই হাসপাতালে ছুটে যান জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু, সাংসদ মহেন্দ্র রায়, জেলা তৃণমূল সভাপতি চন্দন ভৌমিক, শহর ব্লক কংগ্রেস সভাপতি পিনাকী সেনগুপ্ত, রাজ্য তৃণমূল যুব কংগ্রেসের কাযর্করী সভাপতি সৌরভ চক্রবতী, জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি সৈকত চট্টোপাধ্যায় সহ অনান্যরা। |
|
|
|
|
|