চাষিদের স্বার্থে বৃহৎ কৃষক বাজার তৈরির সরকারি উদ্যোগ গোড়াতেই ধাক্কা খেল। এই প্রকল্পের জন্য গত ডিসেম্বরে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আগ্রহপত্র (এক্সপ্রেশন অব ইনটারেস্ট) চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরোনোর পরেও তেমন সাড়া মেলেনি। নবান্ন সূত্রে খবর, আগ্রহপত্র চেয়ে দেড় মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাত্র একটি সংস্থা প্রকল্প গড়তে আগ্রহপ্রকাশ করে আবেদন করেছে। প্রথম দফায় ধাক্কা খেয়ে আগ্রহপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা আরও কিছু দিন বাড়াতে চলেছে রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতর। একই সঙ্গে প্রকল্প গড়ার কিছু শর্ত শিথিল করার কথাও ভাবা হচ্ছে।
কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা জানান, কয়েক বছর আগে একটি বহুজাতিক ও একটি সর্বভারতীয় সংস্থা কলকাতায় বিপণন কেন্দ্র খোলায় লাগোয়া উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বহু চাষি উপকৃত হয়েছেন। তাঁদের আর স্থানীয় ক্রেতাদের মুখ চেয়ে বসে থাকতে হয় না। একই ভাবে জেলাগুলিতেও একাধিক কৃষক বাজার গড়ে গ্রামাঞ্চলে মহাজন ও ফড়েদের কবল থেকে চাষিদের মুক্তি দিতেই বেসরকারি উদ্যোগে বৃহৎ কৃষক বাজার তৈরির পরিকল্পনা করেছে রাজ্য।
সেই লক্ষ্যেই গত ১২ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বৃহৎ কৃষক বাজার তৈরিতে লগ্নির আবেদন জানায় কৃষি বিপণন দফতর। তাতে বলা হয়, দক্ষিণবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বীরভূম ও পূর্ব মেদিনীপুরে এবং উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় ওই বাজারগুলি গড়ে উঠবে। আগ্রহপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ২৪ জানুয়ারি। নবান্নের এক কর্তা জানান, বিজ্ঞাপন দেখে রাজ্যের একাধিক সংস্থা কৃষি বিপণন দফতরে গিয়ে খোঁজখবর করে। ভিন রাজ্যের বেশ ক’জন ব্যবসায়ীও প্রাথমিক ভাবে আগ্রহ দেখান। কিন্তু সময়সীমা পেরোনোর পরে দেখা যায়, একটি মাত্র আগ্রহপত্র জমা পড়েছে। সেটি কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়ের জেলা হাওড়ার একটি সংস্থার। কোনও বহুজাতিক বিপণন সংস্থা রাজ্যের আবেদনে সাড়া দেয়নি।
কেন এমন হল? কারণ খুঁজতে নেমে রাজ্যের জমি-নীতিকেই দায়ী করেছে প্রশাসনের একাংশ। তাদের বক্তব্য, একটি বৃহৎ কৃষক বাজার তৈরি করতে কমপক্ষে ৯০-১০০ একর জমি লাগবে। সেখানে ফসল কেনাবেচার একাধিক স্টল, ব্যাঙ্ক ও বহুমুখী হিমঘরের মতো পরিষেবা থাকবে। আগ্রহপত্রে সরকার বলেছে, কৃষক বাজারে পৌঁছনোর সংযোগকারী রাস্তা, প্রয়োজনীয় জল, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য বাহ্যিক পরিকাঠামো তৈরির জন্য প্রকল্প নির্মাণকারী সংস্থাকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেবে তারা। কিন্তু জমি কেনাবেচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে না সরকার। খুব বেশি হলে উপযুক্ত জমির খোঁজ দেওয়া এবং জমি কেনার পরে মিউটেশন বা রেজিস্ট্রেশনের মতো পরবর্তী কাজগুলি যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে জন্য ওই সংস্থার পাশে থাকবে প্রশাসন।
জমি ছাড়াও রাজ্যে বৃহৎ কৃষক বাজার তৈরিতে বিপণন পরিকাঠামোকে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন আধিকারিকেরা। এই বাধা কাটাতে বছর দেড়েক আগে গ্রামের হাটগুলিকে উন্নত করার পাশাপাশি রাজ্যের সমস্ত ব্লকে একটি করে ছোট মাপের কৃষক বাজার তৈরির রূপরেখা তৈরি করে কৃষি বিপণন দফতর। স্থানীয় চাষিরা যাতে নিজের খেতের ফসল ওই সব বাজারে বিক্রি করতে পারেন, সেটাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু সেই ছোট বাজার তৈরির কাজও খুব একটা এগোয়নি।
কৃষি বিপণন দফতরের আগ্রহপত্রে বলা হয়েছে, বৃহৎ কৃষক বাজার কর্তৃপক্ষ যাতে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে ফসল কিনতে পারেন, তার জন্য ১৫-২০টি ছোট কৃষক বাজার পরিচালনার দায়িত্বও তাদের হাতে তুলে দিতে পারে রাজ্য সরকার। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “ওই সব ছোট মাপের কৃষক বাজার তো প্রায় হয়ইনি!” তাঁর বক্তব্য, প্রথম দফায় রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ৯৫টি ছোট কৃষক বাজার তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিঙ্গুর, ধনেখালি, মেমারি, কালনা ও কাটোয়ায় পাঁচটির কাজ শেষ হলেও বাকিটা কার্যত বিশ বাঁও জলে। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির সাড়া না দেওয়ার এটাও অন্যতম কারণ বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ।
|