রাজ্যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন যথাযথ ভাবে নিয়মকানুন মেনে হচ্ছে না বলে মন্তব্য করল কলকাতা হাইকোর্ট। উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা কলেজের ছাত্রভোট নিয়ে একটি মামলায় এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিচারপতি অশোক দাস অধিকারী। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট না-হওয়ায় সোমবার ওই কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছেন তিনি। এ দিনই হিংসার জেরে স্থগিত রাখা হয়েছে মালদহের চাঁচোল কলেজের ভোট।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ডালখোলা কলেজে নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়ে বিচারপতি দাস অধিকারী মন্তব্য করেন, কলেজ নির্বাচনে ছাত্রছাত্রীরা ভোট দেন। সেখানে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি না-মানলে পরবর্তী কালে দেশের সরকার নির্ধারণ করার নির্বাচনেও ছাত্রছাত্রীরা একই পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানবেন না।
বিশ্বজিৎ বিশ্বাস নামে এক এসএফআই-সমর্থক হাইকোর্টে একটি মামলা করে বলেন, ডালখোলা কলেজে নির্বাচনের নামে সম্পূর্ণ প্রহসন হয়েছে। সংসদের ২১ জন সদস্যই জিতেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এর থেকে বোঝা যায়, সেখানে অন্য কোনও ছাত্র সংগঠন মনোনয়নপত্র পেশ করতেই পারেনি।
হাইকোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, ডালখোলা কলেজ নিয়ে হাইকোর্টের এ দিনের নির্দেশের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, কোনও কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে কারও কোনও অভিযোগ থাকলে এ দিনের মামলার সূত্র ধরে তিনি হাইকোর্টে পৌঁছে যেতে পারেন। এ দিন তার ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন মালদহের কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নুর। রাজ্যে কলেজ
নির্বাচন বন্ধ করার আর্জি নিয়ে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন বলে জানান ওই কংগ্রেস সাংসদ।
ডালখোলা কলেজে কোথায় কোথায় নিয়ম ভাঙা হয়েছে, তার উল্লেখ করে আবেদনকারীর আইনজীবী কৌশিক চন্দ বলেন, কলেজ-কর্তৃপক্ষ ও জেলা পুলিশ কোনও নিয়মই মানেননি। শাসক দলের সংগঠন ছাড়া অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনকে একটিও মনোনয়নপত্র তুলতে দেওয়া হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী ইচ্ছুক প্রার্থীরা থানার ওসি-র কাছ থেকে মনোনয়নপত্র নেবেন এবং তাঁর কাছেই জমা দেবেন। কিন্তু প্রার্থীরা কেন ওসি-র কাছ থেকে মনোনয়নপত্র তুলতে ও জমা দিতে পারলেন না, সেই ব্যাপারে পুলিশ সম্পূর্ণ নিরুত্তর। নির্বাচনের দিন মহিলাদেরও মারধর করা হয়। বোমা পাওয়া গিয়েছে কলেজের সামনের একটি বাড়িতে। তার পরেই বিচারপতি জানিয়ে দেন, ওই কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন বাতিল করা হল।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জয়িতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আইনজীবী মাধ্যমে আদালতের নির্দেশ পেয়েছি। আদালত যা নির্দেশ দেবে, তা পালন করা হবে।” ওই কলেজের ছাত্র সংসদের ২১টি আসনের মধ্যে ছাত্র পরিষদ ন’টি এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রার্থীরা ১২টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। এসএফআইয়ের উত্তর দিনাজপুর জেলার সম্পাদক প্রাণেশ সরকার বলেন, “আইন মেনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া চালানো হয়নি। তাই হাইকোর্টে অভিযোগ জানাই।” ছাত্র পরিষদের জেলা সদস্য নব্যেন্দু ঘোষ এবং টিএমসিপি-র ডালখোলা শহরের আহ্বায়ক প্রদীপ সরকার দাবি করেন, কোথাও কোনও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেনি। তবে তাঁরা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে চলবেন বলে জানান দু’দলের ওই দুই ছাত্রনেতা।
মামলা-মকদ্দমার মধ্যেই ছাত্রভোটে হিংসার দাপট চলেছে পুরোদমে। মালদহের চাঁচোল কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে এ দিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বা টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছে ছাত্র পরিষদ এবং এসএফআই। অভিযোগ, বেলা ১২টা নাগাদ একতলার দু’টি বুথে ঢুকে পুলিশের সামনেই ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে কয়েক জন ছাত্র। বুথের ভিতরেও ভাঙচুর চালানো হয়। ছিঁড়ে ফেলা হয় ব্যালট পেপার। তার পরে শুরু হয় সংঘর্ষ, ভাঙচুর। সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন ছাত্র আহত হন। আহত চার জন ছাত্রকে মালদহে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। পুলিশের লাঠির আঘাতে দুই ছাত্রের মাথা ফেটে যায়। প্রতিবাদে এসএফআই একটানা দু’ঘণ্টা ৮১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখে।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গাহুল আমিন বলেন, “কলেজে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের পরেই নির্বাচন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়কেও।” ওই কলেজের ২৬ আসনের মধ্যে টিএমসিপি ২১টি এবং এসএফআই ২০টিতে প্রার্থী দেয়। ছাত্র পরিষদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চারটি আসন জিতেছে।
মালদহের গাজোল কলেজেও ছাত্র সংসদের ভোটে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গের আশঙ্কা করে হাইকোর্টে আবেদন জমা পড়েছে। রাজ্য সরকারের আইনজীবী অবশ্য তাঁর সওয়ালে বলেন, ওই কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দিন এখনও ঠিক হয়নি। আবেদনকারীর আর্জির ভিত্তিতে বিচারপতি দাস অধিকারী বলেন, ওই কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন যাতে নিয়ম মেনে হয়, তার জন্য সংশিষ্ট থানার ওসি-কে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। বিচারপতির নির্দেশ, ওখানে ছাত্রভোট পরিচালনায় যাতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানা হয়, থানার ওসি-ই তা দেখবেন। |