সমবায়-আবাসন তৈরি করে যাঁরা ফ্ল্যাট বা বাড়ি তৈরি করেছেন, অথচ এখনও নানা কারণে রেজিস্ট্রেশন করাতে পারেননি, সেই মধ্যবিত্তদের জন্য বিশেষ ছাড় দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত, সমবায়-আবাসনের বাসিন্দারা এখন থেকে আর বাজার দরের উপরে নয়, বাড়ি তৈরির খরচের উপর ন্যূনতম ৭.১% হারে রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প ডিউটি দিয়ে সম্পত্তি নিজের নামে নথিভুক্ত করাতে পারবেন। এই বিশেষ ছাড়ের লক্ষ্য এক দিকে যেমন মধ্যবিত্ত গৃহস্বামীদের সরাসরি আর্থিক সুবিধা দেওয়া, তেমনই এর ফলে রাজ্যের ৮০০ কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে বলে আশা অর্থ মন্ত্রকের। বর্তমান আইনে কোনও বাড়ি-জমির রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প ডিউটি ঠিক হয় চলতি বাজার দরের উপর ৭.১% হারে। তবে এই হার ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দামের জমি-ফ্ল্যাট-বাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দাম এর বেশি হলে মালিককে বাজার দরের ৮.১% হারে ওই খরচ মেটাতে হয়।
অর্থ দফতরের হিসেব অনুযায়ী, রাজ্যে এখন প্রায় ৮০ হাজার এই রকম রেজিষ্ট্রেশন না হওয়া সমবায়-আবাসনের ফ্ল্যাট-বাড়ি রয়েছে। এক কর্তার কথায়, “গড়ে এক লক্ষ টাকা করে রেজিস্ট্রেশন এবং স্ট্যাম্প ডিউটি ধরা হলেও ৮০ হাজার ফ্ল্যাট থেকে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। অন্য দিকে, মধ্যবিত্ত বাঙালি, যাঁরা নানা কারণে এখনও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করাতে পারেননি, তাঁরা এই সুবিধার ফলে তিলতিল করে গড়ে তোলা সাধের ফ্ল্যাট বা বাড়িটির আইনি মালিকানা পাবেন। ফলে এটি সরকার এবং ফ্ল্যাট মালিক, উভয় পক্ষের কাছেই আকর্ষণীয় হবে বলে আমাদের ধারণা।”
অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের কথায়, “সমবায়-আবাসনে বাড়ি করেও প্রায় ৮০ হাজার ফ্ল্যাট মালিক তা নিজের নামে নথিভুক্ত করাতে পারেননি। কারণ, জমি-বাড়ির মূল্যায়ন বেড়ে যাওয়ায় রেজিস্ট্রেশনের খরচও বেড়ে গিয়েছে। সেই কারণেই ঠিক হয়েছে, সমবায়-আবাসন তৈরির সময় যে খরচ হয়েছিল, তাকে ভিত্তি করেই রেজিস্ট্রেশন করানো যাবে। বাজার দরে তা দিতে হবে না।” একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর দাবি, এই ছাড় দেওয়ার ফলে সরকার এবং সমবায়-আবাসন মালিক দু’পক্ষই লাভবান হবে।
অর্থ দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ২০১৩ সালের মার্চ মাসের আগে তৈরি হওয়া সমবায়-আবাসনের সদস্যরা সমবায়ের প্রথম অডিট রিপোর্টের কপি-সহ রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে নথিভুক্তি করাতে পারবেন। উল্লেখ্য, প্রথম অডিট রিপোর্টেই বাড়ি তৈরির খরচ পেশ করা হয়। সেই খরচের উপরেই নির্দিষ্ট হারে রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প ডিউটি নেওয়া হবে। তবে কেবল সমবায়ের প্রথম সদস্যই (ফ্ল্যাটের প্রথম মালিক) এই সুবিধা পাবেন। ফ্ল্যাটটি একবার বিক্রি হয়ে গেলে দ্বিতীয় মালিক এই সুযোগ পাবেন না। ২০১৩ সালের মার্চ মাসের পর যে সব সমবায়-আবাসন তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে, তাদের মালিকরাও একই সুযোগ পাবেন। তবে বাড়ি তৈরির দু’বছরের মধ্যে এই রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প ডিউটি মেটানোর কাজটি শেষ করতে হবে। তা না হলে সংশ্লিষ্ট সমবায়ের সদস্যদের ফের বাজার দরের উপরেই স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হবে।
দিন কয়েক আগেই কলকাতা ও তার লাগোয়া এলাকায় জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের সরকারি মূল্যায়ন কমিয়েছে অর্থ মন্ত্রক। এ বারে অর্থ মন্ত্রকের সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, এই ছাড়ের ব্যাপারে বহু দিন ধরেই আবেদন জমা পড়ছিল। মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট মালিকদের বক্তব্য ছিল, গৃহঋণ নিয়ে, সামান্য সঞ্চয় ভেঙে ফ্ল্যাট বা বাড়ি তৈরির পর তাঁরা কপর্দকশূন্য হয়ে যান। ঋণের কিস্তি শোধ, ক্রমবর্ধমান বাজারদর, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, সব মিলিয়ে আর্থিক বোঝার নীচে চাপা পড়ে যায় মধ্যবিত্তের স্বপ্ন। সরকার নির্ধারিত বাজারদরের উপরে ৭.১% স্ট্যাম্প ডিউটি দিয়ে ফ্ল্যাট বা বাড়ি রেজিস্ট্রি করানো তাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “তখন মধ্যবিত্তের স্বপ্ন তো দূর, রাতের ঘুমই যাওয়ার জোগাড় হয়!” এ সব বিবেচনা করেই এই ‘বিশেষ প্যাকেজ’-এর পরিকল্পনা।
অর্থ দফতরের একটি অংশ অবশ্য মনে করছেন, এ বছর রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংশয় রয়েছে। আগামী বছর অন্তত ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এই খাত থেকে আদায় করতে চায় অর্থ দফতর। ফলে রাজস্ব আদায়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরি না করে সরকারের উপায়ও ছিল না।
|