কলকাতা ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের সরকারি মূল্যায়ন ‘বাস্তবোচিত’ করার পথে হাঁটল রাজ্য।
অর্থ দফতরের নতুন নিয়মে ফ্ল্যাট, বাড়ি ইত্যাদি সম্পত্তির ‘সরকারি দাম’ অন্তত ১৫% কমছে। ফলে ঘুরপথে কমতে চলেছে স্ট্যাম্প ডিউটিও। রাজ্যের দাবি, মাথা গোঁজার ঠাঁই কিছুটা হলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের হাতের নাগালে এনে দিতেই এই সিদ্ধান্ত। এতে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি আবাসন শিল্পমহল। আবাসন নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই-এর আশা, এর ফলে ব্যবসায় নতুন করে জোয়ার আসবে।
বাজার দর যা-ই হোক, সাধারণত স্ট্যাম্প ডিউটির হিসেব কষা হয় সরকারি মূল্যায়নের উপরে ভিত্তি করেই। অর্থাৎ, কোনও একটি ফ্ল্যাট যে দামেই কেনা হয়ে থাকুক না কেন, রাজ্য তার দর যত হওয়া উচিত বলে মনে করে, তার উপরেই স্ট্যাম্প ডিউটি গুনতে হয় ক্রেতাকে। ফলে এখন সেই মূল্যায়ন কমলে, স্ট্যাম্প ডিউটি কমবে। সব মিলিয়ে কমবে ফ্ল্যাট-বাবদ মোট খরচের বোঝা। একইসঙ্গে কিছুটা লাঘব হবে করের অঙ্কও।
কী ভাবে?
ধরা যাক, কোনও ক্রেতা ১০ লক্ষ টাকা দামে ফ্ল্যাট ‘বুক’ করেছেন এবং কিনেছেন। কিন্তু ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে সরকারি হিসেব অনুযায়ী তার দাম দাঁড়াল ১৫ লক্ষ টাকা। এ বার কিন্তু ওই ক্রেতাকে ১৫ লক্ষ টাকা দামের উপরেই ৭% হারে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে রেজিস্ট্রেশন বাবদ আরও ১%। কিন্তু সমস্যা হল, সাধারণত ফ্ল্যাটের আসল দামের (এ ক্ষেত্রে ১০ লক্ষ) উপরে হিসেব কষেই ব্যাঙ্ক থেকে ধার মেলে। ফলে ওই বাড়তি টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খান সাধারণ ক্রেতা। সরকারি মূল্যায়ন কমার দরুন স্ট্যাম্প ডিউটিও কমলে সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে। |
জায়গা |
ছিল |
হল |
সেক্টর ফাইভ |
৮,০০০ |
৪,৫০০ |
রাজারহাট (বাণিজ্যিক) |
৭,০০০ |
৪,৮০০ |
ডোভার রোড |
৮,০০০ |
৭,০০০ |
ইস্ট তপসিয়া রোড |
৩,৫০০ |
৩,০০০ |
সরকারি মূল্যায়নের হিসেব প্রতি বর্গফুটে টাকায় |
|
তা ছাড়া কেন্দ্রের নিয়ম অনুযায়ী, ফ্ল্যাট-বাড়ি-জমির আসল দাম ও সরকারি মূল্যায়নের মধ্যে যে ফারাক থাকে, কেনার পরে তার উপরে ৩২% হারে আয়কর দিতে হয়। সুতরাং ‘সরকারি দাম’ কমলে, সেই দুশ্চিন্তাও কিছুটা কমবে।
তাই কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকায় (গড়িয়া, নরেন্দ্রপুর, বারাসত, মধ্যমগ্রাম ইত্যাদি) এই নয়া নিয়ম বলবৎ হলে চাহিদা বাড়বে বলে মনে করছে আবাসন শিল্পমহল। ক্রেডাইয়ের দাবি, ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতির চাপে অন্যান্য শিল্পের মতোই সমস্যার শিকার নির্মাণশিল্পও। তার উপর চড়া স্ট্যাম্প ডিউটির কারণে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন বহু ক্রেতা ও বিক্রেতাই। সেই পরিস্থিতি বদলাবে। ক্রেডাই বেঙ্গলের প্রেসিডেন্ট হর্ষবর্ধন পটোডিয়ার কথায়, “সরকারি মূল্যায়নের বাস্তববাদী হিসেব বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত খুবই কাজের।”
গত কয়েক মাস ধরেই বিষয়টির উপরে কাজ করছিল রাজ্য। সরকারি সূত্রে খবর, শহরের বিভিন্ন এলাকা, রাস্তা ধরে তৃণমূল স্তরে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। বাজারদরের সঙ্গে নিজেদের মূল্যায়নের সঙ্গতি রাখতেই এই সমীক্ষা জরুরি ছিল বলে রাজ্য সরকারের দাবি। অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, “মা-মাটি-মানুষের সরকারের লক্ষ্য সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। আর সেই সূত্রেই এই সিদ্ধান্ত। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করা সহজ হবে।”
শুধু আবাসন শিল্পই নয়, এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পমহলও। ক্রেডাই সূত্রে খবর, সরকারি মূল্যায়ন অনুযায়ী, সেক্টর ফাইভে প্রতি বর্গফুটের দাম ছিল আট হাজার টাকা। তা এখন কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে ৪,৫০০ টাকায়। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পমহলের মতে, এর ফলে অফিস তৈরির জন্য জায়গা লিজ নেওয়া বা কেনার উৎসাহ বাড়বে। সহজ হবে ব্যবসা শুরু করা। ক্রেডাই-এর সুশীল মোহতাও জানান, এই অঞ্চলে লেনদেন বাড়বে বলে তাঁরা আশাবাদী।
যুক্তমূল্য কর বা ভ্যাটের পরেই স্ট্যাম্প ডিউটি থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করে রাজ্য। সে ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমানোয় তার আদায়ও কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। রিয়েল এস্টেট উপদেষ্টা সংস্থা কুশম্যান ওয়েকফিল্ডস-এর অন্যতম কর্তা অভিজিৎ দাস বলেন, “এত দিন চড়া ডিউটির ভয়ে অনেকে সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন (নথিভুক্ত) করতেন না। এখন দাম কমায় সেই কাজ দ্রুত করতে চাইবেন তাঁরা। ফলে এই খাতে সরকারি আয় এক লাফে অনেকটাই বাড়বে।” |