অটোর দৌরাত্ম্যে জেরবার দুই জেলাও
শুধু শহর নয়, জেলার শহরতলির বাসিন্দারাও অটোর দাপটে অতিষ্ঠ। কোথাও যাত্রীভাড়া নিয়ে, কোথাও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে অটো চালকদের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা সেখানেও রোজনামচা। জেলায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনের নজকদারি থাকলেও কার্যত অটো-ট্রেকারের নিয়ন্ত্রণ কলকাতা শহরের মতোই তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিত্য যাত্রীদের অভিযোগ, এ নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে নানা সময়ে অভিযোগ করা হলেও পরিস্থিতির বদল হয়নি। উল্টে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অটো-ট্রেকার চালকেরা।
উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যাত্রীদের পরিবহণ মূলত অটো-ট্রেকারের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তার উপর বাসভাড়া না বাড়ার কারণে বহু জায়গাতেই বাস চলাচলের সংখ্যা কমে গিয়েছে। ফলে আরও বেড়ে গিয়েছে অটো-ট্রেকারের উপর যাত্রীদের নির্ভরতা। কিন্তু অটো-ট্রেকার চলাচলের উপরে তেমন নিয়ন্ত্রণ বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের অটো-ট্রেকার চালকদের অবিচারের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, ক্যানিং তিন মহকুমাতেই বিভিন্ন বাস, মিনিবাসের পাশপাশি প্রচুর অটো- ট্রেকারও চলে। ডায়মন্ড হারবার থেকে ফলতা, উস্তি, সহরারহাট, মগরাহাট, সরিষা, রায়চক, নুরপুর প্রভৃতি জায়গায় অটো চলে। মথুরাপুর স্টেশন মোড় থেকে রায়দিঘি, ঘোড়াদল আবার রায়দিঘি থেকে বোলের বাজার, দমকল জেটিঘাট, জটার দেউল পর্যন্ত অটো চলে। এ ছাড়াও কুলপি থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর, ঢোলাহাট, মন্দিরবাজার থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত অটো চলাচল করে।
ঝুঁকি নিয়ে এ ভাবেই চড়তে হয় অটোয়।—নিজস্ব চিত্র।
অন্যদিকে, কাকদ্বীপ মহকুমার কাকদ্বীপ থেকে জুমাই লস্কর, গঙ্গাধরপুর, সাগর, নামখানা বিভিন্ন রুটে অটো রয়েছে। অটোগুলিতে নির্দিষ্ট সংখ্যায় যাত্রী নেওয়া ব্যাপারে নিয়ম থাকলেও বলাবাহুল্য কোনও অটোচালকই সেই নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। পাশাপাশি অন্যান্য যানবাহনের সমস্যার কারণে উপায় না থাকলেও গন্তব্যে পৌঁছতে যাত্রীরাও সেদিকে নজর দেন না ফলে মাঝেমধ্যেই অটো উল্টে দুর্ঘটনা ঘটে। যেমনটি ঘটেছে গত ২২ জানুয়ারিফলতায় দিঘিরপানা বাসমোড়ের কাছে। পাঁচজন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ১০ জন পড়ুয়া একটি অটোতে যাচ্ছিলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অটো উল্টে মাকা যান প্রধানশিক্ষক। গুরুতর জখম হন ৯ জন। ওই ঘটনার পর এবং সম্প্রতি কলকাতা শহরে যাত্রীদের উপর অটোচালকদের আক্রমণের পর পর কয়েকটি ঘটনায় যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যাত্রীদের অভিযোগ, পুলিশ প্রশাসন এ ব্যাপারে কড়া মনোভাব না নিলে এই ধরনের ঘটনা ঘটবেই। শুধু পুলিশ নয়, অটোচালকদের বেপরোয়া আচরণ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দিকেও আঙুল তুলেছেন তাঁরা।
অটোর দৌরাত্ম্যে নাজেহাল আর এক মহকুমা ক্যানিংয়ের বাসিন্দারাও। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, এক সঙ্গে সাত-আট জন যাত্রী না হলে যেতে চান না অটোচালকেরা। তা ছাড়া মহকুমার বিভিন্ন রুটে অটো চলাচল করলেও অধিকাংশ অটোরই রুট পারমিট নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কোনও নজরদারি নেই। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও সেদিকে কারও নজরউ পনে না। নিত্যযাত্রী মনিরুল পুরকাইত বলেন, “গোলাবাড়ি থেকে অটোয় ক্যানিংয়ে এসে কলকাতায় কাজে যাই। অতিরিক্ত যাত্রী না হলে অটো ছাড়তেই চায় না। আবার সন্ধ্যার পরে ক্যানিং থেকে অটোয় ফেরার সময় অতিরিক্ত ভাড়া চান অটোচালকেরা। প্রতিবাদ করলে অটো থেকে নেমে যেতে বলা হয়। কটূক্তিও করা হয়।”
ক্যানিংয়ের মহকুমাশাসক প্রদীপ আচার্য বলেন, “রুট পারমিটের বিষয়টি পরিবহণ দফতর দেখে। অটো নিয়ে যা সমস্যা রয়েছে তা প্রশাসনিক ভাবে আলোচনা করে মেটানোর চেষ্টা করছি।” এসডিপিও বিশ্বজিৎ মাহাতো বলেন, “ অতিরিক্ত যাত্রী তোলার ব্যাপারে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।”
উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চল ব্যারাকপুরেও অটো-অটোচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শেষ নেই মানুষের। পথ আটকে স্ট্যান্ড, দুর্ব্যবহার, অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার অভ্যাস বদলায়নি মন্ত্রীর নির্দেশ এবং প্রশাসনের নজরদারিতেও। তার চেয়েও যেটা নিয়ম ভাঙার ঘটনা সেটা হল, অটোর গায়ে লেখা পারমিট অনুযায়ী রুটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো রুট তৈরি করে নেন অটোচালকেরা। ব্যারাকপুর-ডানলপ রুট এর অন্যতম পথ প্রদর্শক। শুধু এই রুটেই প্রায় দু’হাজার অটো চলে এখন। ডানলপ থেকে ব্যারাকপুর লেখা অটোকে পুরো পথ যাওয়ার চারজনের ভাড়া দিতে চাইলেও যেতে চান না অধিকাংশ চালকেরা। অন্তত চারবার অটো বদলে পৌঁছতে হয়। অটো চালকদের সাফাই, গ্যাসের দাম, অটোর কিস্তি সব মিলিয়ে যা আয় হয় সেই অনুপাতে ভাড়া বাড়েনি তাই ভাঙা রুটের যাত্রা তোলা ছাড়া গতি নেই। অন্যদিকে যাত্রীদের অভিযোগ, এই রুটে ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়েছেন চালকেরা। ব্যারাকপুরের বাসিন্দা প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্তা জনরঞ্জন গোস্বামী বলেন, ‘‘বছর দুয়েকের মধ্যে অনেক অটো বেড়েছে। কিন্তু অটোচালকদের আচরণ এত ভয়ঙ্কর যে আতঙ্ক হয় অটোয় চাপতে। বৃদ্ধ বয়সে অকারণে অসম্মানিত হতে ভাল লাগে না।’’ অটোর দৌরাত্ম্য রুখতে ব্যারাকপুর ট্রাফিকের প্রাক্তন ডিসি কল্যাণ মুখোপাধ্যায় ফেসবুকে অভিযোগ নেওয়া ও তখনই ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ কিছুটা কাজে দিয়েছিল। কিন্তু রুট ভেঙে গাড়ি চালানোর সমস্যা তাতে মেটেনি।
অটো নিয়ে শিল্পাঞ্চলের মতো একই অভিজ্ঞতা বনগাঁ মহকুমার মানুষেরও। যাত্রীদের অভিযোগ, অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত ভাড়াও নেন অটো চালকেরা। যদিও আর এক মহকুমা বসিরহাটে অটো নিয়ে অবশ্য ভিন্ন সুর শোনা গিয়েছে। পাঁচজনের বেশি যাত্রী না নেওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি থাকলেও কোনও অটো যদি তার বেশি যাত্রী নেয় এবং তা অটো ইউনিয়নের নজরে আসে তা হলে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত ওই অটোর জরিমানা করা হয় বলে ইউনিয়ন সূত্রে জানানো হয়েছে।
যদিও সাম্প্রতিক কালে অটোচালকদের হাতে যাত্রী নিগ্রহের কয়েকটি ঘটনার পর পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, ‘‘অটো নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে জানান। বেআইনি কোনও কিছু বরদাস্ত করা হবে না।’’ যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসন ও সরকারের প্রতিনিধিদের কথাগুলো শুধু কথারে কথা হয়েই থেকে যাচ্ছে। আর তার ফলে অটোর দৌরাত্ম্য ক্রমশ বাড়ছে।

তথ্য সংগ্রহ: দিলীপ নস্কর, সামসুল হুদা,
বিতান ভট্টাচার্য, সীমান্ত মৈত্র এবং নির্মল বসু।





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.