কান্না থেমেছে। কাঁপুনিও কমেছে অনেকটা। খাবার দেখলে হামলে পড়ছে। খুনসুটিও করছে নিজেদের মধ্যে।
আবার খাঁচার কাছাকাছি কাউকে দেখলেই তিন জনে জড়াজড়ি করে গুটিসুটি মেরে বসে থাকছে। চোখে ফিরে আসছে আতঙ্কের ছায়া।
পশু চিকিৎসকেরা বলছেন, দু’টোই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন ধরে পাচারকারীদের সঙ্গে থাকায় মানুষ সম্পর্কে ভীতি তৈরি হয়েছে এক থেকে দেড় বছরের তিনটি শিম্পাঞ্জি-শাবকের। অচেনা জায়গায় এসে তাই তারা কাঁদছিল, কাঁপছিল। তিন জনে একই খাঁচায় অন্ধকারে বেশ কয়েক ঘণ্টা থাকার পরে তারা কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। তাই খাবারে আগ্রহ বেড়েছে। ফিরে এসেছে খুনসুটির মেজাজ। এই বয়সের শিম্পাঞ্জিদের স্বাভাবিক আচরণ এটাই। অর্থাৎ নতুন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে নিতে তারা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
স্বাভাবিকতায় ফেরাটা সম্পূর্ণ করতে আলিপুর চিড়িয়াখানার নতুন অতিথি, তিন শিম্পাঞ্জিকে অন্তত ২১ দিন লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দু’টি বালক এবং একটি বালিকা শিম্পাঞ্জিকে তাদের মধ্য আফ্রিকার জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে পাচারকারীরা। শুল্ক দফতরের হেফাজত থেকে এখন তাদের নতুন ঠিকানা চিড়িয়াখানা। সেখানকার হাসপাতালে একই খাঁচায় পরস্পরকে পেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে ওরা। চিড়িয়াখানার অধিকর্তা কানাইলাল ঘোষ শুক্রবার বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী তিনটি শিম্পাঞ্জিকে অন্তত ২১ দিন লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হবে। প্রয়োজনে সেটা ৩০ দিন বা তার বেশিও হতে পারে।” |
বন্যপ্রাণী দফতরের এক কর্তা জানান, হাতিদের মতো শিম্পাঞ্জিরাও দল বেঁধে থাকতে ভালবাসে। বুধবার রাতে একটি বালক শিম্পাঞ্জি তিন জনের দল থেকে আলাদা হয়ে চিড়িয়াখানায় এসে বেশ মুষড়ে পড়েছিল। শুল্ক দফতরের হেফাজতে থাকার সময় মুষড়ে পড়েছিল অন্য দু’টি শিম্পাঞ্জিও। বৃহস্পতিবার রাতে ফের একত্র হতে পেরে তিন জনেই মানসিক চাপ কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে তাঁর অনুমান।
বৃহস্পতিবার রাতে চিড়িয়াখানায় পৌঁছনো দু’টি শিম্পাঞ্জি বেশ ক্ষুধার্ত ছিল বলে জানান চিড়িয়াখানার এক কর্তা। বয়স অনুযায়ী তাদের যতটা খাবার খাওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি খেতে চাইছিল তারা। কিন্তু হঠাৎ বেশি খেয়ে ফেললে পাছে অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেই আশঙ্কায় তাদের বাড়তি খাবার দেওয়া হয়নি। এ দিন সকালে তিন শিম্পাঞ্জি-শিশুই ল্যাকটোজেন-৪, আপেলের স্বাদের সেরেল্যাক, কলা ও আপেল খেয়েছে। পরে তার সঙ্গে দেওয়া হয় দুধ-পাউরুটিও। চিকিৎসকেরা তিন জনেরই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই চিকিৎসক বা যাঁরা খাবার দিচ্ছেন, তাঁরা দল বেঁধে যাচ্ছেন না। কারণ, তাতে তারা ভয় পেতে পারে।
তা হলে কবে ওই তিন শিম্পাঞ্জিকে দর্শকদের সামনে হাজির করানো হবে?
অধিকর্তা জানান, এখনও পর্যন্ত আলিপুর চিড়িয়াখানা তাদের অস্থায়ী ঠিকানা। আদালত বা প্রশাসনিক স্তরে সিদ্ধান্ত না-হলে তিনি এই ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করবেন না।
তবে চিড়িয়াখানা সূত্রের খবর, যদি আলিপুর চিড়িয়াখানাই ওই শিম্পাঞ্জিদের স্থায়ী ঠিকানা হয়, সে-ক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদা জায়গার দরকার না-ও হতে পারে। কারণ, বাবু নামে পুরুষ শিম্পাঞ্জিটি যেখানে রয়েছে, সেখানে একাধিক শিম্পাঞ্জি থাকতে পারে। প্রত্যেকের খাঁচা আলাদা। যাকে বা যাদের যে-দিন দর্শকদের সামনে আনা হবে, তাকে বা তাদেরই শুধু খাঁচা থেকে বার করে দেবেন চিড়িয়াখানার কর্মীরা।
মধ্য আফ্রিকা থেকে বিমানে হংকং ও বাংলাদেশ হয়ে সড়কপথে তিন শিম্পাঞ্জির সঙ্গে পাঁচটি মার্মোসেট, কয়েকটি ম্যাকাও, কাকাতুয়া, ধূসর টিয়াও পাচার করা হয়েছিল কলকাতায়। বাগুইআটির দক্ষিণপাড়ার একটি বাড়ি থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। মার্মোসেটদেরও চিকিৎসা চলছে চিড়িয়াখানার হাসপাতালে, লোকচক্ষুর আড়ালে। তাদের দুধে ভেজানো পাউরুটি খেতে দেওয়া হচ্ছে।
এ দিন বিকেলে শুল্ক দফতর থেকে ফ্যাক্স-বার্তায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়, শিম্পাঞ্জি-মার্মোসেট ছাড়াও সে-দিন বাগুইআটির ওই বাড়িতে অন্তত ২৭৮টি প্রজাতির পাখি পাওয়া গিয়েছিল। চিড়িয়াখানা-কর্তৃপক্ষ যেন তাদের নিয়ে যান। এক বারে না-পাঠিয়ে দফায় দফায় পশুপাখি পাঠানোয় চিড়িয়াখানা-কর্তৃপক্ষ বেজায় ক্ষুব্ধ। চিড়িয়াখানার আধিকারিক কানাইবাবু বলেন, “শুল্ক দফতর আইনের ধার ধারছে না। শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রে প্রথমে বলা হল তিনটি। অথচ পাঠানো হল একটি। তিন দিন আগে পাখিগুলো বাজেয়াপ্ত করা সত্ত্বেও আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। অথচ এ দিন ওরা জানাচ্ছে, ওদের দফতরে গিয়ে পাখিগুলো নিয়ে আসতে হবে।” বন্যপ্রাণ আইন অনুসারে চিড়িয়াখানার হেফাজতে পশুপাখি দিতে হলে সেখানে পৌঁছে দিতে হয়।
চিড়িয়াখানা সূত্রের খবর, সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে একটি আহত পূর্ণবয়স্ক বাঘও আসছে চিড়িয়াখানায়। তার পায়ে ও পিঠে চোট রয়েছে।
|