|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ২... |
|
পাল্টে গিয়েছে আমার জীবনটাই |
চার বছর ধরে ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে
উপলব্ধি অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের। বললেন কৃশানু ভট্টাচার্য-কে। |
হোক না রানাঘাট বা ধানবাদ। গ্রামগঞ্জে বা শহরে নাটকের দল নিয়ে তিনি মঞ্চে উঠলেই ভরা দর্শকাসন থেকে ভেসে আসা ‘জয় তারা’ তাঁর কানে জয়ধ্বনির মতোই বাজে।
নাটক শেষে বয়স্ক দর্শকেরা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁকে স্বয়ং বামদেব মনে করে প্রণাম করার জন্য। তিনি মনে মনে মা তারার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। ফোনে তাঁকে বামদেব জ্ঞানে পুজো করতে চান গ্রামের বাড়ির কোনও গৃহকর্ত্রী। সিঙ্গুর থেকে সাতসকালে ফোনে সেখানকার এক বয়স্ক চিকিৎসক আবদার করেন, চৈতন্য মহাপ্রভুর ভূমিকায় এ বার তাঁকে অভিনয় করতে হবে!
শুনেছেন, বিখ্যাত সব রাজনৈতিক নেতারাও নাকি নিয়মিত দেখেন তাঁর সিরিয়াল। গত প্রায় চার বছর ধরে ই টিভি চ্যানেলে ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’র ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে জনপ্রিয়তার এমন মাতাল করা নানা স্তর পেরিয়ে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছেন তাঁর শিল্পী-জীবনের সেরা প্রাপ্তির উচ্চতায়। “অবশ্যই পারতাম, এই জনপ্রিয়তা ভাঙিয়ে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স বাড়ানো থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই করতে। কিন্তু মন সায় দেয়নি,” এই চরিত্রে এমনই ডুবে আছেন অরিন্দম যে, বহু অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন। “মাকে অবহেলা করতে পারব না। এর জন্য রোজগারও কমে গিয়েছে,” শু্যটিংয়ের বাইরেও তিনিও যেন বামদেবই।
তাঁর অভিনয় দেখার জন্যই দর্শকেরা বসেন টিভি-র সামনে। তাঁর অভিনয়ের উপরে ভর করেই টিআরপির দৌলতে ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ বেলা সাড়ে ১২টার স্লট পেরিয়ে পৌঁছে যায় প্রাইম টাইমে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। কিন্তু তিনি নির্বিকার। অবলীলায় বলতে পারেন, “এর জন্য অজস্র ধন্যবাদ প্রাপ্য চিত্রনাট্যকার ঋতম ঘোষাল, প্রযোজক এবং ফিল্ম এডিটর সুব্রত রায়-সহ পুরো ইউনিটের। ঋতমের স্ক্রিপ্টের গুণে ‘বামাক্ষ্যাপা’র জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বেড়েছে। রাতদিন খাটছে ছেলেটা।”
চোখধাঁধানো সাফল্য পাওয়ার পরেও এমন নিরহঙ্কারী থাকেন কী করে?
গত চার বছরে বাল্যবন্ধু বুম্বার (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) অনুরোধে ‘কনকাঞ্জলি’ ছাড়া আর কোনও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেননি। মজে আছেন বামদেবের ভূমিকায়। “অভিনয় করতে করতে উপলব্ধি করলাম, মা তারার কৃপায় কখন যেন পাল্টে গিয়েছে আমার গোটা জীবনটাই। ”
স্টুডিয়োয় পৌঁছে মেকআপ নেওয়ার পর থেকেই অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় যেন আক্ষরিক অর্থেই বামদেব হয়ে যান, মন্তব্য করেছিলেন ঋতম। একদম সত্যি! শু্যটিংয়ের সময় লাল চেলি পরা একমুখ দাড়িগোঁফে সুসজ্জিত বামদেব রূপী অরিন্দম যখন অষ্টমীর মতো কিশোরীকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য তার মাথায় দু’হাত রেখে মায়ের নাম স্মরণ করেন, তখন মনেই হয় না এ তাঁর অভিনয়!
শু্যটিং শেষ করে সাজঘরে ফিরে আসার পরেও তিনি অনেকক্ষণ চুপচাপ। তখনও যেন আটকে আছেন বামদেবের খোলসে। ধীরে ধীরে ঘোর কাটিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এই সংসারে কেন এত হিংসা আর হানাহানি জানেন?” অরিন্দমের উপলব্ধি, না-পাওয়ার ক্ষোভ আর বঞ্চনা থেকেই এই পৃথিবীতে যত বিপত্তি। সবাই মনে করে, সাফল্য তারাও পেতে পারত। কিন্তু তারা পেল না। রাজনৈতিক বা সামাজিক সব ক্ষেত্রেই এটা ঘটছে।
“আমার মধ্যেও এই অনুভূতি কাজ করত। আমিও ভাবতাম, আমার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। সংস্কৃতি জগতে আমার অবদানের জন্য যে-প্রচার আমার পাওনা ছিল, তা আমি পাইনি। আমার মনের মধ্যে যে কত ক্ষোভ জমে ছিল!”
আর এখন? ছোট পর্দায় বাংলা ধারাবাহিকের ইতিহাসে ঈর্ষণীয় মাইলফলক পেরিয়ে যাওয়ার পরে তিনি তো নিজেই এখন ইতিহাস। এমনকী গুগলে সার্চ করলে ‘বামাক্ষ্যাপা’র উইকিপিডিয়ায় কালোত্তীর্ণ সেই মাতৃসাধকের যে-জীবনকথা আছে, সেখানেও স্থান করে নিয়েছেন অরিন্দম। ই টিভির এই ধারাবাহিক নিয়ে সেখানে ব্যয় করা হয়েছে অনেক শব্দ। “দারুণ সংবাদ। সারা পৃথিবী জানতে পারবে। বাংলা সিরিয়ালের এ-ও একটি মাইলফলক”, তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য। |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
কম্পিউটারে খুব একটা দক্ষ নন। কিন্তু জানেন, ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে হাজার চারেক মন্তব্য করা হয়েছে। গত চার বছরে তাঁর জীবনে যা-কিছু ঘটেছে, সবই মায়ের ইচ্ছায়, এমনটাই মনে করেন তিনি। ২০১২ সালের অক্টোবরে ‘বামাক্ষ্যাপা’ যাত্রায় বামার ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি ফিরছিলেন কলকাতায়। অণ্ডালের মোড়ে তাঁর গাড়ি ধাক্কা মারে দাঁড়িয়ে থাকা লরির পিছনে। তার পরে কী ঘটেছিল, তাঁর মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান, তাঁকে ভ্যানে তুলছেন পুলিশ কর্মীরা। বুক ভেসে যাচ্ছে রক্তে। “বিশ্বাস করি, তারা মা-ই সে-দিন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। না-হলে অত রাতে ওখানে কেন দাঁড়িয়ে থাকবেন পুলিশ কর্মীরা?” অল্পবিস্তর চোটআঘাত ছাড়া আর দিন পঁচিশ বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার পরেই ফের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। “কী করে?”
এই দুর্ঘটনার মাধ্যমে মা তারা তাঁকে একটি বার্তা দিয়েছিলেন বলেই তাঁর বিশ্বাস। কী সেই বার্তা? “মা চাননি, আমি যাত্রায় বামাক্ষ্যাপার চরিত্র করি”, মা তারার উপরে তাঁর কী অমোঘ বিশ্বাস! বাড়িতে দু’বছর ধরে রটন্তী কালীপুজো করার পরে তাঁর উপলব্ধি, মা তারা চান না তিনি এ পুজো করেন। প্রতিবারই বিঘ্ন ঘটেছে পুজোয়।
অথচ এই চার বছরে তারাপীঠে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। সে কী? এখনও যাননি? বামদেবের জন্মস্থান আটলায় গিয়ে তাঁর সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল পর্দায় দেখা বামদেবকে চাক্ষুষ করতে। তারাপীঠে যাওয়ার পরে কী হবে? “মা জানেন”, তাঁর সরল উত্তর।
শিশুশিল্পীরা বড় হয়ে গেলে সাধারণত হারিয়ে যায়। তিনি যাননি। জীবনের উত্থান-পতনের সবথেকে বড় সাক্ষী তিনি নিজেই। জানালেন, ‘শ্রীমান হংসরাজ’ এবং ‘মাদার’ সুপারডুপার হিট করার পরে পুলিশ প্রহরা ছাড়া তিনি কোনও অনুষ্ঠানেই যেতে পারতেন না।
“পাকা চাকরি ছাড়িয়ে বাবাকে ঘরে বসিয়ে দিলাম। নিজের উপরে অগাধ বিশ্বাস থেকেই এটা করেছিলাম। আজ বুঝি, কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সে-দিন।”
গায়ক-অভিনেতা হিসেবে এর পরে শুরু হয়েছিল তাঁর সংগ্রামের দিন। অভাবঅনটন কাকে বলে আগে তা কখনও না-দেখা অরিন্দম তখনও অটল ছিলেন তাঁর ঈশ্বরীয় বিশ্বাসে। “স্টারডম থেকে স্ট্রাগল দেখেছি সবই। দুঃসময়ের সাক্ষী আছেন আমার প্রতিবেশী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।”
বাড়িতে চাল কেনার মতো টাকাও নেই। কিন্তু অদৃশ্য কারও হস্তক্ষেপে ঘোর বিপদও পার হয়ে আসতেন। সে-এ কি মা তারার কৃপায়? হয়তো।
বাড়ি বয়ে কেউ না-কেউ এসে দিয়ে যেত একটা অনুষ্ঠানে গান করার বায়না। “নৌকা ডুবতে ডুবতে আবার ভেসে উঠত”, ফেলে আসা দিনে ফিরে যাওয়ার পরেও তাঁর মুখে খেলা করে প্রশান্তি। জীবন তো এমনই! পাশাপাশি স্কুলের পাঠ সেরে ভর্তি হয়েছিলেন কলেজে। থেমেছেন গ্র্যাজুয়েট হয়েই।
তার পরে দু-তিনটি বাংলা ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে সাফল্য না-পাওয়ায় তাঁর কেরিয়ার যখন ফের বেসামাল, তখনই তাঁকে সাহিত্য-নির্ভর বাংলা ধারাবাহিক ‘সেই সময়’-এ ফিরিয়ে এনেছিলেন জোছন দস্তিদার। তাঁর দৃঢ় ধারণা, আসলে এ সবই ছিল বামার ভূমিকায় তাঁর শিল্পী জীবনের সেরা পাওনার আগে তাঁকে নিয়ে মায়ের লীলাখেলা। এক দিকে ‘নীলাঙ্গুরীয়’, ‘লৌহকপাট’-এর মতো সিরিয়ালে অভিনয় করছেন। অন্য দিকে নাটকে অভিনয় আর গানও সমানে চালিয়ে গিয়েছেন।
এক দিকে যখন বড় পর্দায় ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘মিশর রহস্য’-র মতো টানটান বাংলা ছবি, অন্য দিকে ছোট পর্দায় ‘দাদাগিরি’, ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ আর চ্যানেলে চ্যানেলে অল্পবয়সি নায়িকাদের জয়জয়কার, তখনও কী করে ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’র টিআরপি থাকে ই টিভির শীর্ষে?
‘নীল সীমানা’র পরে ভেবেছিলেন, ধারাবাহিকে আর অভিনয় করবেন না। তাঁর কাছে যখন বামার ভূমিকায় অভিনয় করার প্রস্তাব এসেছিল, তখনও তাঁর মনে দূরদর্শনের ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ ধারাবাহিকের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা। “তখনও ভুলিনি ধারাবাহিকের মাঝরাস্তায় ওরা আমাকে কী ভাবে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী যখন বললেন, মা হিরোইন হয়ে তোমাকে অভিনয় করতে ডাকছেন, তখন বুকের মধ্যে এই কথাটা খুব বেজেছিল। আমি যেন প্রাণ পেলাম।” তার পরে আর পিছন ফিরে তাকাননি।
সাত বছর পরে ২১০০ পর্ব পেরিয়ে যাওয়া ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’র তুঙ্গ সাফল্যের দিনে, জনপ্রিয়তার জোয়ারে অবিরত ভেসে থাকা অরিন্দমের চেতনায়-মননে-অনুভূতিতে কেবল মা তারার ঈশ্বরীয় অনুভব। কালোত্তীর্ণ মাতৃসাধকের সহজ সরল মানবীয় করুণার যে রসে তাঁকে চিত্রনাট্যকার ভিজিয়ে রেখেছেন, ক্রমাগত সেই ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে নিজের অজান্তেই তিনি সন্ধান পেয়েছেন ভারতীয় দর্শনের সেই চিরায়ত সত্য পার্থিব সব কিছুই এ বিশ্বে নশ্বর। “নামযশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি-ধনদৌলত থেকে শুরু করে কী পেলাম আর কী পেলাম না, আমার আর কোনও কিছুতেই কিছু এসে যায় না। কিছুই আর মনে দাগ কাটে না।”
তাঁর স্পষ্ট অনুভূতি, সাধকের যে টার্গেট, তিনি পৌঁছে গিয়েছেন সেখানে। এখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি। “যে না পৌঁছেছে, সে বুঝবে না।” সংস্কৃতি জীবনে না-পাওয়া এখন আর তাঁকে ব্যথিত বা পীড়িত করে না।
‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ ছাড়াও তাঁদের চার্বাক গোষ্ঠীর নাটক ‘চলো পটল তুলি’, ‘দুধ খেয়েছে ম্যাও’, ‘এখন তখন’ তো হাউসফুল। এ সব নাটকে তিনি একাধারে নাট্যকার-সুরকার-গায়ক এবং পরিচালক। অভিনয়ও করেন। নাটকে তাঁর সব অবদানই মনে দাগ কেটেছে দর্শকদের। এ সব নিয়েও কোনও হেলদোল নেই তাঁর।
নিজের মা ছাড়া প্রথাসিদ্ধ ভাবে কারও কাছে গান শেখেননি। অকপটে স্বীকার করেন, “গানের টেকনিক্যাল দিক থেকেও ততটা পারদর্শী নই, নোটেশন তেমন না-বুঝেই সুর করি।” তার পরেও গ্রামগঞ্জে কী ভাবে অবলীলায় শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন দেড়ঘণ্টার গানের অনুষ্ঠানে? “সবই মায়ের ইচ্ছায় হয়ে যায়।” অরিন্দম এখন কাজ করেন কেবল কাজের আনন্দে।
এক দিন তো এই ধারাবাহিক শেষ হয়ে যাবে। তখন কী করবেন? জীবনটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হবে না? “জানি, কষ্ট হবে। আরও বেশি দুঃখ পাব, সেই সব লক্ষ লক্ষ বয়স্ক দর্শকের কথা ভেবে, যাঁরা বামাকে আঁকড়ে ধরেই এই সাত বছর কাটিয়েছেন। মুষড়ে পড়বেন তাঁরাও।”
এর পরে আর ধারাবাহিকে অভিনয় নয়, পুরোপুরি চলে যাবেন পরিচালনায়। “আর কী করব? জানি না। মা তারা জানেন।”
মা তারার সাধক সন্তান অবিনাশী বামদেবের মতোই নিজের ভালমন্দ সব তারাপীঠের মায়ের হাতেই সঁপে দিয়ে ছোট পর্দার জীবন্ত বামদেব নিশ্চিন্তে বলতে পারেন, ‘‘মায়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।”
অভিনয় কখনও কখনও জীবনের কাহিনিকেও হার মানায়! |
|
|
|
|
|