মনোরঞ্জন ১...
স্বপ্নে দেখা রাজরানি
লোকচিত্রী ধীরেন দেব একটা সার কথা বলেছেন সুচিত্রা সেন সম্পর্কে। যে, কেউ কাছাকাছি আসতে চাইলে ওঁর, সম্পর্কটা শেষ হয়ে যেত।
তাতে হলিউডের গ্রেটা গার্বোর কথাটা মনে এল। যাঁর সঙ্গে কথায় কথায় তুলনা চলত সুচিত্রার। তুলনার একটা কারণ এই যে, ১৯৪১-এ শেষ ছবি ‘টু ফেসেড উওম্যান’ (দু’মুখো নারী) করে ১৯৯০-এ মৃত্যু অবধি গার্বো আর কোনও দিন ক্যামেরার সামনে এলেন না। যেমন কি না সুচিত্রাও। ১৯৭৮-এ ‘প্রণয়পাশা’ করে সেই যে সরে গেলেন স্টুডিয়ো ও ক্যামেরা থেকে, ২০১৪ অবধি আর ফেরানো গেল না।
তবে ধীরেন দেবের কথা যেটা মনে পড়াল তা এই জীবনগত মিল নয়। আরও গভীরের, আরও মনস্তাত্ত্বিক, আরও নির্মম নিঃসঙ্গতার। আগে গার্বোর ব্যাপারটা শুনে নিই।
বিংশ শতকের এক সেরা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল কন্ডাক্টর লেওপোল্ড স্টোকোস্কির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন একবার গার্বো। জীবনে দু’জন পুরুষেরই পায়ের কাছে বসতে দেখা গিয়েছে নায়িকাকে। এক, অমর চলচ্চিত্রকার এরিক ফন স্ট্রোহাইম। আর দুই, লেওপোল্ড স্টোকোস্কি। দ্বিতীয় জন ওঁকে দুনিয়ার গল্পে গল্পে মাতিয়ে রাখতেন আর দুনিয়া দেখানোর স্বপ্ন দেখাতেন।
একটা সময় ওঁদের বিয়ের কথা রটতে শুরু করে। রোমের এক পত্রিকা ওঁদের বিয়ের তারিখও ঘোষণা করে দেয়। ফলে যা হবার তা-ই হল, সিসিলি দ্বীপের যে ছোট্ট গ্রাম তাওরমিনায় ওঁরা ছিলেন, সেখানে শ’য়ে শ’য়ে রিপোর্টার উড়ে এল। গার্বোর সন্দেহ হয়েছিল খবরটা রোমের কাগজে স্টোকোস্কিই দিয়েছেন। কাজেই একটা ছোট্ট সাংবাদিক বৈঠক ডেকে বসলেন তিনি। ডেকে কী বললেন?
বললেন, “বিয়ের পিঁড়িতে বসার কোনওই বাসনা ছিল না আমার কোনও দিন। বন্ধু স্টোকোস্কি কিছু সুন্দর জিনিস দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাই অনেক আশা নিয়ে আসা। কিন্তু কী বোকা, ভেবেছিলাম কেউ এখানে আমাকে খুঁজে পাবে না!
আচ্ছা, আমাদের পিছনে ধাওয়া না করলেই কি নয়? যারা একটু শান্তিতে থাকতে চায় তাদের নির্জনতা কেড়ে নেওয়াটা নির্মম কাণ্ড। আমার কাছে সেটা সৌন্দর্য হত্যার শামিল। আমি তো একটেরে মানুষ, একেবারে একলা... অন্যরকম হতে যে চাই না, তা নয় কিন্তু পারি না। আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। আমাকে একলা থাকতে দিন। একলা।”
বলা বাহুল্য, ওই ইতালি সফরেই গার্বো-স্টোকোস্কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। যদিও ইতালির কাগজে কাগজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মুখে হিটলারের সঙ্গে মুসোলিনি, কী চেম্বারলেনের সঙ্গে হিটলারের বৈঠকের খবরকে কোণে সরিয়ে দিচ্ছে এই জল্পনা: স্টোকোস্কি কি সত্যিই গার্বোর শয্যাসঙ্গী?
সুচিত্রার প্রেম নিয়ে কম আজগুবি জল্পনা হত না সে-সময়। সুচিত্রা-উত্তমের একটা করে ছবি হিট হলেই ওদের বিয়ে দিয়ে দিত পাড়ার ছেলেরা। এ ছাড়া নায়িকার জীবনে নতুন কে এল বা গেল, এই সরল রোমাঞ্চকর গুলতানিতে মজে থাকত কলকাতার পাড়ার পর পাড়া। এ তো পেজ থ্রি, পেজ সিক্স, টিভি চ্যানেলাদির বহু পূর্বেকার জমানা। সুচিত্রা ঠিক কবে থেকে নিজেকে নির্মমভাবে আড়াল করতে শুরু করলেন তা দিনক্ষণ মেপে বলা মুশকিল। তবে কিছু বলছেন না, অথচ পত্রপত্রিকায় হাবিজাবি অজস্র কথা ছেপে বার হয়ে যাচ্ছে, এও দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এক সাংবাদিক সে-প্রসঙ্গ তুলতে নাকি বলেছিলেন, “মিথ্যে লিখেও যদি কেউ দুটো পয়সা রোজগার করতে পারেন তো করুন না।”
কিন্তু তাতে যে গুজবই বেশি ছড়াবে সেটা মনে করানোয় বেশ মজার মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, “হ্যাঁ, যদি হলিউডের নায়ক এরল ফ্লিন-এর ‘মাই উইকেড উইকেড ডেজ’-এর মতো আত্মজীবনী লিখতে পারতাম তা হলেই লিখতাম। যাতে গোপন বলে কিচ্ছু নেই। আমার জীবনে এমন সব ঘটনা আছে যে একবার যদি মুখ খুলি তো কিছু ঘর ভাঙবে। কিছু কিছু সংসারে আগুন জ্বলতে পারে। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই হয়তো ভাল।”
তবে এই চুপ করে থাকাটা কেবলই অন্যের সংসার বাঁচানোর জন্য হয়তো নয়। আত্মজীবনী লেখার কথা উঠছে যখন, তখন সুচিত্রা স্টুডিয়ো ফ্লোরেও রিপোর্টার, ফোটোগ্রাফার ঢোকা বন্ধ করে দিচ্ছেন। গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে তুলনা টানা শুরু হয়নি, তবে গার্বোর মতো ‘ডিভা’ টেম্পারামেন্ট, সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী মেজাজ চোখে পড়ছে লোকের। এর কিছুটা হয়তো স্বামীর সঙ্গে সংসার টলে যাওয়ার কারণে, কিন্তু অনেকটাই হয়তো এখানেও গার্বোর মতোই শুধু সিনেমার লোকজন, কাজকারবারে নিজেকে বিলগ্ন না রাখা। ওঁর বন্ধুসমাজ ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছিল, সিনেমায় থেকেও সিনেমার থেকে স্বাধীন একটা জীবন উনি খুঁজছিলেন এবং, হয়তো, পাচ্ছিলেনও। কিন্তু প্রেম? সেভাবে দেখলে দুজনের কেউই যে খুব প্রেম-ভালবাসা খুঁজে বেড়িয়েছেন ভাবা কঠিন। গার্বো তো বলতেনই যে বিয়ের শপথ নেওয়ার জন্য গির্জার অল্টার অবধি যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। সাংবাদিকরা ‘বিয়ে কবে?’ ‘বিয়ে কবে?’ করে বিরক্ত করলে গেয়ে দিতেন, ‘এই করলাম বলে! মনের মতো একটা ছেলে পেলেই হয়।’ সুচিত্রা কিন্তু তখন নিতান্তই রমা দাশগুপ্ত বেশ ভাল রকম কম বয়েসে বিয়েটা সেরে ফেলেছিলেন। রমার বয়স ষোলো, বছরটা ভারত স্বাধীনতার বছর। ১৯৪৭। বিয়ে হতে রমা পাবনা ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়, ৩২ নম্বর বালিগঞ্জ প্লেসে। আর পাবনা ও কলকাতা ভাগাভাগি হয়ে যায় দুই দেশে।
পাত্রী হিসেবে রমাকে দেখে হবু স্বামী দিবানাথ জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ মেয়েকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেন না। এবং বিয়ের পরে মুনমুন আর এক ছেলে (জন্মের কিছু দিনের মধ্যেই মারা যায়) হওয়া অবধি প্রেমের ঘোর প্রায় কারওরই কাটেনি। তার পরেও যে রমা সিনেমায় এলেন তার পুরো উদ্যোগটাই কিন্তু দিবানাথের। প্রথম-প্রথম স্ত্রীকে দিয়ে সিনেমায় প্লে-ব্যাক করানোর বন্দোবস্ত করেন। অডিশনে উতরে গেলেও নেপথ্যে গান করা হয়নি রমার।
তার পর তো দিবানাথ বৌকে সিনেমায় নামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রযোজকের থেকে অ্যাডভান্সও নিয়ে বসেছিলেন। শেষে একদিন রাশভারী শ্বশুরমশাই আদিনাথ সেনের সামনে দাঁড়িয়ে তরুণী বধূকে সিনেমায় পার্ট করার অনুমতি চাইতেই হল। বাকিটা ইতিহাস।
গার্বোর অভিনয়ে আসাটা কিন্তু দুই কারণে। প্রথমত, কিছু আয় করার প্রবল প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বৃত্তি নিয়ে সুইডেনের অভিজাত রয়্যাল ড্রামাটিক অ্যাকাডেমিতে স্তানিস্লাভস্কি প্রবর্তিত ‘মেথড’ অ্যাক্টিং রপ্ত করা। বলতে নেই, এই মেথড শিক্ষায় তিনি ওই পদ্ধতিতে শিক্ষিত তিন সেরা মার্কিন অভিনেতারও পূর্বসূরি ছিলেন। তাঁরা হলেন জেমস ডিন, মার্লন ব্র্যান্ডো, ও মন্টগোমেরি ক্লিফট। এই তিন জনেরই তিনি পূর্বসূরি ছিলেন আরেক ব্যাপারেও। কুঁড়েমি, মেজাজ এবং প্রতিবাদী স্বভাবে। কিন্তু অভিনয় পদ্ধতি ও সূক্ষ্মতা থেকে চোখ সরানো নেই। চিত্র সমালোচক আলেকজান্ডার ওয়াকার লিখেছিলেন, “গার্বোর কোনও ছবি দেখার পর স্তানিস্লাভস্কির লেখায় ফিরে গেলে মনে হত, আরে মহিলা এগুলোই তো খুলে দেখিয়েছেন ওঁর অভিনয়ে! মেথড তো ওঁর রক্তের মধ্যে, অ্যাকাডেমি কেবল সেটাকে নিপুণ করেছে।”
একটা সময় অবধি অভিনয়কেই প্রেম হিসেবে নিয়েছেন গার্বো, তার পর এক সময় সেই অভিনয় থেকেই পালিয়ে বেঁচেছেন। সুচিত্রা যতই অভিনয়ের ভেতরে ঢুকেছেন, ততই ওঁর বৈবাহিক প্রেম আলগা হয়ে গিয়েছে। হয়তো এই কারণেই তিনি মুনমুনকে বোর্ডিং-এ রেখে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। লন্ডনের প্রান্তে সারি কাউন্টির এক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেন। মুনমুন যেতে চাননি, কারণ বাবা দিবানাথকে ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছেই ছিল না। শেষ অবধি যেতে হয়েছিল। এই নিবন্ধকারকেই একদিন বলেছিলেন মুনমুন, যে ইংল্যান্ডের স্কুলজীবন তিনি একেবারেই উপভোগ করেননি।
গার্বো বা সুচিত্রা কেউই আত্মজীবনী লিখলেন না। গার্বোর সৌভাগ্য (সৌভাগ্যটা বেশি কার, নায়িকার না সিনেমা জগতের বলা মুশকিল) অঢেল উত্তম জীবনী লেখা হয়েছে ওঁর, অগুন্তি সেরা প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন, এবং তোলা হয়েছে ওঁকে নিয়ে পাঁচটি দুরন্ত তথ্যচিত্র। নিজের জীবন, যাপন, ভাললাগা, ভাল-না-লাগা এবং ভাল বাসতে পারা বা না-পারা নিয়ে অজস্র কথা এই সব লেখায় ছড়িয়ে আছে। সুচিত্রার কিন্তু সেরকম আত্মজীবনী মূলক উচ্চারণ প্রায় খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে কী ভাবে যে বিশ্বাসযোগ্য কোনও জীবনী লেখা হবে ওঁর, সে ধন্ধ থেকেই যাচ্ছে। একটা বাস্তব, নির্মেদ, নির্মোহ জীবনী আদৌ কি সম্ভব হবে?
এই কারণেই হয়তো আনন্দবাজারের তরফে একবার এক সাংবাদিক ও মুনমুনকে দিয়ে সুচিত্রার স্মৃতিচারণা রেকর্ড করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই রেকর্ডিং, সেই বই লেখা হতে পারল না, কারণ তিন-তিন বারের চেষ্টাতেও মা’কে রাজি করাতে পারেননি মুনমুন। ২
গার্বোর প্রেম কিংবা সুচিত্রার প্রেমের রটনায় আসতে হলে আরেকটা বিষয় ছুঁতে হবে। দুই মহিলার চেহারা ও চরিত্রের মিলগুলো ঠিক কোথায়? কিংবা জীবনের।
গার্বো প্রয়াত হন চুরাশি বছর বয়েসে। সুচিত্রা মাত্র এক বছর কমে, তিরাশিতে। ১৯২১ থেকে ১৯৪১ এই কুড়ি বছরে ২৯টা ছবি করেছিলেন গার্বো, যার মধ্যে আটটা সুইডিশ, বাকি ইংরেজিতে। আর সুচিত্রা ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ এই পঁচিশ বছরে ৬০টা ছবি করেছেন, যার মধ্যে সাতটা হিন্দিতে, বাকি সব বাংলায়।
গার্বো এবং সুচিত্রার সব চেয়ে আলোচিত মিল তাঁদের রূপলাবণ্যে। গ্রেটা গার্বোকে তো মানাই হত বিশ্বের এক সেরা সুন্দরী, যাঁর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলত ওঁর চাহনি, উপস্থিতি ও ব্যক্তিত্বের রহস্য। বিখ্যাত আলোকচিত্রী আর্নল্ড গেন্থ, যাঁর তোলা আনা পাভালোভা ও ইসাডোরা ডানকানের পোর্ট্রেট মস্ত সাড়া তুলেছিল, পারতপক্ষে বিনা মেকআপে, অতি সাধারণ পোশাকে গার্বোর যে-সব ছবি তুলেছিলেন তাতেই মাত হয়ে গিয়েছিল হলিউড। ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ পত্রিকায় সে-সব ছবি দেখে এম জি এম কর্তা হুকুম দেন মহিলাকে এক্ষুনি আনতে হবে হলিউডে।
একই কাণ্ড সুচিত্রাকে নিয়েও। কী যে চাহনি মহিলার, চোখের কোণ দিয়ে, কাচ কাটা হিরে যেন। তুলনায় গার্বোর ছিল ভারী চোখের পর্দা মেলে এক শূন্য চাহনি। দুজনেই এক পাশে মাথা হেলিয়ে, কোনাকুনি তাকিয়ে, ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করে, মুখমণ্ডল দিয়ে যাবতীয় আলো ও ফটোগ্রাফারের মনোযোগ শুষে নিতেন। গেন্থ বলেছেন যে গার্বোকে শু্যট করতে গিয়ে তিনি টের পেয়েছেন যে তিনি মুখ নয়, মুখের পিছনের কোনও কিছুর দ্বারা বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন। মহিলার আত্মার ছবি তোলার বাসনা হয়েছিল।
এ বাসনা কোন আলোকচিত্রীর হয়নি, যিনি ক্যামেরা তাক করেছেন সুচিত্রার দিকে? এত নো-ননসেন্স, ব্যক্তি ময়ী মানুষটির এত খোলামেলা হাসি, চোখের ভাষা, বাঁধভাঙা লাবণ্য ও চাপা নখরা অত অবলীলায় কী করে উঠে আসত ক্যামেরায়, এও এক রহস্য বইকী! ক্যামেরার লেন্সকে নিজের আয়না বানিয়ে ফেলতেন গার্বোও, কিন্তু ওঁর সেরা ফটোগ্রাফেও কোথায় যেন, যৎসামান্য হলেও, একটা গাম্ভীর্যের ছায়া থেকে যায়।
তুলনায় দেখুন ধীরেন দেবের তোলা সুচিত্রার অফুরান ছবি। হাসি, লাবণ্য, সৌন্দর্য ও নখরার উৎসব। অনেক ছবিকেই নায়িকার চালু ইমেজের সঙ্গে মেলানোও কষ্ট। অথচ এরকম একটা দিক তো ওঁর ছিলই বরাবর। যাঁরা জানেন তারা জানেন। ওঁর প্রেমের দিকটা কি সেরকম একটা দিক, যার আবছা ইঙ্গিত আমরা পাই, পুরো ছবিটা কখনও পাই না?
ওঁদের পছন্দ

কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
১। সাত পাকে বাঁধা
২। সপ্তপদী
৩। পথে হল দেরী
৪। হারানো সুর
৫। সাড়ে চুয়াত্তর

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
১। হারানো সুর
২। সপ্তপদী
৩। সাত পাকে বাঁধা
৪। দীপ জ্বেলে যাই
৫। আঁধি

সৃজিত মুখোপাধ্যায়
১। সপ্তপদী
২। দীপ জ্বেলে যাই
৩। উত্তরফাল্গুনী
৪। সাত পাকে বাঁধা
৫। চাওয়া পাওয়া
রুপোলি পর্দায় সুচিত্রা ও উত্তমের যে-রসায়ন সারাক্ষণ ধরা পড়ে সেটা কি ভিতরকার কোনও রাগ-অনুরাগ থেকে আসে? গত ষাট বছরের মতো আগামী ষাট বছরও বাঙালি মনে হয় এই গবেষণাতে মেতে থাকবে। হাতের কাছে ওঁদের ছবির সিডি, ডিভিডি সব যখন আছে।
মুনমুনের কাছে শুনেছি বাড়ি বসে টিভি-তে কখনও সখনও ছবিটবি দেখলেও নিজের করা ছবি দেখতেন না সুচিত্রা। এটা কি নিজের অতীত অনুভূতি থেকে সরে আসতে? বলা হয়, সুচিত্রা-উত্তমের সম্পর্কটা গভীর বন্ধুত্বের ছিল, কামনা-বাসনার কোনও সংস্রব ছিল না। এরল ফ্লিন-এর ‘মাই উইকেড উইকেড ডেজ’-এর মতো এক স্মৃতিকথা সুচিত্রা সত্যিই যদি লিখতেন, তা থেকে প্রেমিক উত্তম কতখানি অব্যাহতি পেতেন তা নিয়ে চর্চার অভাব হবে না বাঙালির।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা না-বললেই নয়। উত্তমের সঙ্গে অনেক মহিলারই প্রেমের সম্পর্কের কথা শোনা ও জানা যায়। কিন্তু তা নিয়ে কী আর এমন হেলদোল মানুষের? যত কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা সুচিত্রাকে নিয়ে। আর বাঙালি যুবকের চোখে সুচিত্রা সেই কবের থেকে যে স্বপ্নে দেখা এক রাজকন্যা, তার মোদ্দা কারণ তারা মনে মনে উত্তমের রোল প্লে করে সেই সব জটিল, ঘনিষ্ঠ সিনেমা-মুহূর্তে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, মধ্যকলকাতার মধ্যবিত্তপাড়ার একটা ঘটনা নিয়ে এই উত্তম-সুচিত্রা মাদকতার কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়া যেতে পারে। শুনুন...
পাড়ার চোখকাড়া সুন্দরী রতুর চোখকাড়ার তাল কষছে মনে-মনে নিজেকে উত্তম বানিয়ে বসা ছোকরা মণি। রতু সে-সব দেখেও দেখে না, মাথাতে তো নেই-ই। বেশ কিছু দিন ওদের বারান্দার নীচে হাঁটাহাঁটি করে ফল হল না-দেখে শেষে উত্তম-সুচিত্রার এক ছবি থেকেই ফন্দি চুরি করল মণি। এক বাচ্চাকে লাগাল ওঁত পেতে থাকতে রতু কখন হাতে বই নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামবে ইস্কুল যেতে। রতু নামা শুরু করলেই যেন সিটি দেয়।
সিটি পড়ল, মণি দুদ্দাড় করে উত্তম স্টাইলে ওঠা ধরল যাতে ধাক্কা লেগে রতুর বইগুলো মাটিতে পড়ে, আর সে বই তুলে দিতে দিতে নায়ক-নায়িকা কিসিমে চোখাচোখি হয়। কিন্তু হায় ‘সাগরিকা’! হায় বাঙালি! নামতে নামতে রতু থামল ওর জুতোর স্ট্র্যাপ ঠিক করতে, ফলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ওঠা মণি বুলফাইটের মত্ত ষাঁড়ের মতো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে শুধু চড়েই গেল, এবং রোম্যান্সের অধঃপতন ঘটল।
সুচিত্রা-উত্তমের এই প্রেম বা প্রেমের ছবি যে ভাবে আক্রান্ত করেছে বাঙালিকে, সে ভাবে কিন্তু সমাজে সম্পৃক্ত হয়নি গ্রেটা গার্বোর কোনও ঘোষিত প্রেম। আর গার্বোর ঘোষিত প্রেমের কি কোনও সংখ্যা ছিল?
তবে প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে জন গিলবার্টের সঙ্গে ওঁর রুপোলি পর্দা ও সোনালি যৌবনের মাখামাখি। গিলবার্টের অনস্ক্রিন ক্যারিশমা ও প্রেমদৃশ্যের অভিনয় ওঁকে রুডলফ ভ্যালেন্তিনোর সার্থক উত্তরসূরি করেছিল হলিউডে। তিরিশের দশকের সেই বিখ্যাত ডিপ্রেশন বা মন্দার যুগেও তিনি মাইনে হাঁকতেন সপ্তাহে দশ হাজার ডলার! সদ্য হলিউড আগত গার্বো এর ভগ্নাংশও পেতেন না। কিন্তু নায়িকা প্রথম রাতেই বেড়াল মেরেছিলেন। কী রকম?
চাইলেই মেয়ে পটাতে পারেন এই এলেম তো ওঁর ছিলই, তাই গিলবার্ট প্রথম দর্শনেই করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “হাই গ্রেটা, তোমায় দেখে খুশি হলাম!” তাতে গার্বোর জবাব ছিল একটা রুক্ষ “আমি মিস গার্বো’’। বলেই নিজের ড্রেসিং রুমে ঢুকে যান।
অনতিকালে নিজের দুরন্ত সুপুরুষ সুইডিশ প্রেমিক শ্যেন হুগো বর্গকে ছেড়ে প্রেমে পড়েন গিলবার্টের, কিন্তু একেবারে নিজের মেজাজে, নিজের শর্তে। কোনও পুরুষের ক্ষমতা, প্রতিভা বা গরিমায় নড়ে যাবার পাত্রী একেবারেই ছিলেন না গার্বো। এবং এখানে অপূর্ব মিল ওঁর আর সুচিত্রার। সুচিত্রা ও সৌমিত্রের অপূর্ব অভিনয়ে কী দারুণ ছবি হয়েছিল ‘সাত পাকে বাঁধা’। কিন্তু সে রকম জুটি তো ওঁরা হলেন না। যেমনটি হতে পারেননি গার্বোর সঙ্গে তখনকার অবাক করা তরুণ প্রতিভা লরেন্স ওলিভিয়ে। গার্বোর সঙ্গে প্রথম অভিনয় সম্পর্কে এভাবে লিখেছেন ওলিভিয়ে:
“আমি বেশ নার্ভাসই ছিলাম এবং কিছুটা ভয়েও। আমি জানতাম ওঁর পাশে আমি কত হালকা অভিনেতা একজন...”
এই খোঁচ সৌমিত্রের অবশ্যই ছিল না। যদিও সুচিত্রা সম্পর্কে ওঁর একটা অনুশীলিত নীরবতা কারও চোখ এড়িয়ে যাবার নয়। সমীহ ব্যক্ত করতে একবার অবশ্য সুন্দর করে বলেছিলেন, “মাঝে মাঝে ফ্লোরে সুচিত্রা সেনকে একটু দূর থেকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম। আমার মনে হত তাঁর মতো আর একজন নায়িকাকে কেন দেখতে পাই না। ‘সাত পাকে বাঁধা’য় অভিনয়ের জন্য সুচিত্রা সেন মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা অভিনেত্রীর যোগ্য পুরস্কারই পেয়েছিলেন। এ রকম একজন অভিনেত্রীর জন্য অবশ্যই গবর্বোধ করতে পারি।”
স্মৃতিকথা লেখার সময়ে ওলিভিয়ে অবশ্য গার্বোর শীতলতার কথা না উল্লেখ করে পারেননি। লিখেছেন, “গার্বো যেন কাঠ। মহান অভিনেত্রী এরকম অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে মেলে ধরবেন, এই তো সকলের আশা। তা না, আমার আলিঙ্গনে তিনি পাথরের মতো ঠান্ডা মেরে গেলেন।... আমরা একটু হাঁটাহাঁটি করলাম, এক সঙ্গে ধূমপান করলাম, টুকরোটাকরা বাতচিতও হল। তারপর ফিরে গেলাম সিনটা করতে। আর গার্বো ফের আগের মতো পাথর হয়ে গেলেন।”
পর্দায় নিজের একটা স্টাইল ছিল সুচিত্রার। সেই স্টাইলই ওঁর কাছে মুখ্য হত। তবে সেই স্টাইলেই যেহেতু দর্শক মাত হত তাই সেই স্টাইলকেই স্বীকার করে নিতে হবে জানিয়েছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। সেই স্টাইলের কথা উল্লেখ করে অজয় কর অবশ্য বলেছিলেন, “আমার ‘সাত পাকে বাঁধা’ সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে সুচিত্রা এই স্টাইল ভেঙে তার অভিনয়কে একটা উচ্চতায় তুলে দিতে পেরেছিল।”
‘সাত পাকে বাঁধা’তে স্বামীর ভূমিকায় সৌমিত্রর পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দেওয়ার দৃশ্যটা একটা রসায়ন না ঘটিয়ে করে তোলা যায় কি না বলা মুশকিল। আরও মুশকিল এই যে, ওঁর ছবির কাজ, সেরা মুহূর্তের অভিনয় সম্পর্কে সুচিত্রার কাছ থেকে প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না।
সে দিক দিয়ে অবশ্য অভিনয়, এমনকী প্রেমের অভিনয় সম্পর্কেও অজস্র স্মরণীয় পর্যবেক্ষণ রেখে গেছেন গ্রেটা গার্বো। প্রেমের দৃশ্যের অভিনয় নিয়ে ওঁর এমন এক মন্তব্য তুলে দিচ্ছি...
“প্রেম কিন্তু খুব নাটকীয় নয়। প্রেম ও রোম্যান্সের পেছনে কী আছে তাতেই সেরা আবেগ ও অনুভূতির সঞ্চার করে। শ্রেষ্ঠ আবেগ কী, সে আমি জানি না। হয়তো ত্যাগ স্বীকার। তবে ত্যাগও তো প্রেমের একটা বড় অংশ।”
তাঁর প্রেমের অভিনয় জীবনকেই তো বলিদান দিয়েছিলেন। সুচিত্রাও সেটা করেছিলেন বলেই না এত তুলনা, প্রতিতুলনা গার্বোর সঙ্গে ওঁর। সিনেমা করা ছেড়ে দেওয়াও ছাড়া এত ঘোরতর ভাবে অদৃশ্য, অন্তরালবর্তিনী হওয়ার মধ্যে এক হাড়হিম করা সাযুজ্য দু’জনের। ভিন রাজ্য থেকে এসে (পাবনা, ঢাকায় এই সেদিনই শুনে এলাম লোকজন বলেই চলেছে ‘আমাগোর সুচিত্রা’) সিনেমা জগৎকে একজন পুরুষের মতো শাসন করে দু’জনেই দশকের পর দশক ধরে এক ধরনের মরণোত্তর জীবন ও খ্যাতির স্বাদ নিয়ে গেলেন। জীবনে পাওয়ার কিছু বাকি ছিল না, জীবনের শেষেও কী পাওয়া যায় তাও ওঁরা জেনে গিয়েছিলেন।
ছবি করা ছেড়ে দেওয়ার পর পরই অন্তরালে যাননি সুচিত্রা। রবীন্দ্রসদনে বিরাশির আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবেও হাজিরা দিতেন সকাল ন’টার শো-এ। তার পর হঠাৎ একদিন প্রায় অসূর্যম্পশ্যা হতে শুরু করলেন। শুধু কানে আসত সুযোগ করে বেলুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ শুনতে যান। বই জোগাড় করে পড়েন মা সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে। আরও পরের দিকে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে ভাবতেন কিনা জানা যায় না। অযথা আতঙ্কিত ছিলেন বলেও মনে হয় না।
তবে সিনেমা ও মৃত্যুকে জড়িয়ে এক অপূর্ব মন্তব্য করে গেছেন গ্রেটা গার্বো। যাঁকে রুপোলি পর্দায় কতবারই তো মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। বলেছিলেন, “যদি তোমাকে পর্দায় মরতে হয়, তাহলে তোমাকে মনের দিক থেকে শক্ত আর শরীরের দিক থেকে তাজা থাকতে হবে।”
মৃত্যুর আগে কিডনির সমস্যায় ভুগেছেন গার্বো, সপ্তাহে তিন দিন করে ডায়ালিসিস চলত। একেবারে শেষে প্রায় কমলকুমার মজুমদারের মতো একটা কথা বলেছিলেন। “মৃত্যুকে বরণ করা শিখতে হয়। যদি খুব সুস্বাস্থ্যে থাকো, তাহলে বুঝতে হবে মৃত্যুর প্রস্তুতি সঠিক হয়নি... আমি প্রায়ই মৃত্যু নিয়ে ভাবি।” মৃত্যুর একেবারে মুখোমুখি এসে সুচিত্রা খুব বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন।

ছবি: ধীরেন দেব।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.